প্রশ্নবিদ্ধ আমদানি ঋণপত্রে (এলসি) এবার গায়েব করঅ হয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৬ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স না থাকলেও বছরের পর বছর ধরে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে এই অর্থ নিয়ে গেছে দুটি প্রতিষ্ঠান। কাগজে-কলমে কাঁচামাল আমদানি দেখানো হলেও এর বিপরীতে পণ্য রপ্তানি হয়নি। প্রতিষ্ঠানের গুদামেও এসব কাঁচামাল বা পণ্যের অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়েছে এলসি জালিয়াতির ভয়ংকর এ ঘটনা। শুল্ক ও তদন্ত অধিদপ্তরে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের আলাদা দুটি চিঠি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। কারসাজির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে কিনা—এমন প্রশ্ন তুলছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি ও কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগ থেকে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরে পাঠানো চিঠির তথ্য অনুযায়ী, এসআইবিএলের বনানী শাখা থেকে শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৮৮৯টি ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলে। এসব এলসির বিপরীতে ব্যাংকটি পরিশোধ করেছে ১৫৮ কোটি ৫০ লাখ ২৪ হাজার ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৬৪২ কোটি ৭৫ টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা অনুযায়ী, শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে লাইসেন্সের মেয়াদ দুই বছর। এ ছাড়া ৫ হাজার টাকা ফি দিয়ে প্রতি ২ বছর পরপর লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। আর পণ্য প্রস্তুতের পর ২৪ মাস এবং বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরও বেশি সময় তা ওয়্যারহাউসে রাখার বিধান রয়েছে।
গাজীপুরের টঙ্গীর শার্প নিটিংয়ের নামে ২০০৩ সালের ২ এপ্রিল বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স ইস্যু করা হয়, তবে এরপর আর তা নবায়ন করা হয়নি। শুধু তাই নয়, ওই সময়ের পর থেকে বারবার প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় তা বন্ডের অধীন শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় পড়ে না। হালনাগাদ বন্ডেড ওয়্যারহাউসের লাইসেন্স না থাকলেও দীর্ঘ ৬ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি ইস্যু করেছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের বনানী শাখা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন বলছে, শুল্ক রেয়াতি সুবিধায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে আমদানি করা কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু শার্প নিটিং থেকে কোনো পণ্যই রপ্তানি হয়নি। প্রতিষ্ঠানের গুদামে গিয়ে আমদানি করা কাঁচামাল বা তা থেকে প্রস্তুত পণ্যের কোনো মজুত পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল।
সরেজমিন গাজীপুরের টঙ্গীর পাগার এলাকায় শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানা গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে কারখানার নিরাপত্তা প্রহরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ৩ মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। এক সময় এখানে কয়েকশ শ্রমিক কাজ করলেও বর্তমানে শুধু ডাইংয়ের জন্য ৭ থেকে ৮ জন শ্রমিক আছেন।
ওই প্রহরী বলেন, ‘শুনেছি কারখানার নামে প্রচুর ঋণ রয়েছে। মাঝে মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের লোকজন আসেন।’
শার্প নিটিংয়ের এলসির বিপরীতে পরিশোধ করা অর্থের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে এসআইবিএলের বনানী শাখার ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমি এক মাস আগে এই শাখার দায়িত্ব নিয়েছি। এত বিপুল পরিমাণ টাকার এলসির বিষয়ে আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। বিষয়টি আমার জানা নেই।’
ব্লাইথ ফ্যাশনের সন্দেহজনক এলসি
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মিরপুর শাখার গ্রাহক ব্লাইথ ফ্যাশন লিমিটেডের এলসির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। গত ৮ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি ও কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগ থেকে শুল্ক ও তদন্ত অধিদপ্তরে পাঠানো আরেক চিঠির তথ্য অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানের কোনো বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স নেই। এর পরও ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্লাইথের অনুকূলে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে শুল্ক রেওয়াতি সুবিধার আওতায় ১২৩টি মাস্টার এলসির মাধ্যমে ৬৭ লাখ ৪০ হাজার ৪১৬ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়, যার বিপরীতে ৮ লাখ ৪২ হাজার ৬৬৩ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়নি। একই সময়ে ওই গ্রাহকের অনুকূলে ৩৫০টি ব্যাক টু ব্যাক এলসি ইস্যু হয়েছে। যার পরিমাণ ৫৫ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ ডলার। অর্থাৎ, দুই দফায় প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৬৩ লাখ ৫০ হাজার ৩৫৩ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়নি, যা বাংলাদেশি টাকায় ৬৬ কোটি ৬৭ লাখ।
ব্যাংকের নিজস্ব পরিদর্শনে ব্লাইথ ফ্যাশনের কারখানা বন্ধ গেছে এবং সেখানে আমদানি করা কাঁচামাল বা প্রস্তুতকৃত কোনো পণ্য পাওয়া যায়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরেজমিন গাজীপুরের কাশিমপুরের গোবিন্দবাড়ি এলাকায় ব্লাইথ ফ্যাশনের কারখানাটি বন্ধ রয়েছে। সেখানে ৩ জন নিরাপত্তা প্রহরী দায়িত্ব পালন করছেন। তারা জানান, কারখানাটি ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ। সিরাজগঞ্জের বেলকুচির এম সামসুল আরেফিন ও তার ভাই শাহরিয়ার পারভেজ এই প্রতিষ্ঠানের মালিক। বর্তমানে তারা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। কবির হোসেন নামে তাদের এক আত্মীয় এটি দেখাশোনা করেন। কারখানাটির কর্তৃত্ব বর্তমানে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের হাতে। তারা প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির চেষ্টা করছে। বর্তমানে এ কারখানার মূল্য ১০ থেকে ১১ কোটি টাকা বলেও জানান নিরাপত্তা প্রহরীরা।
এসআইবিএলের মিরপুর শাখার ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ব্লাইথের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি চলমান। কী পরিমাণ ঋণ আদায় হয়েছে তাও এ মুহূর্তে বলতে পারব না। ঋণের ফাইলটি হেড অফিসে রয়েছে।’
ব্লাইথ ফ্যাশনের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক কবির হোসেন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ৩ জন নিরাপত্তারক্ষী কারখানাটি দেখাশোনা করেন। মালিকরা দেশের বাইরে। ব্লাইথ ফ্যাশনের নামে কখনো এত বিপুল পরিমাণ অর্থের এলসি হয়নি বলেও দাবি করেন কবির।
তিনি আরও বলেন, ‘সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক জমি কেনার জন্য ঋণ দিয়েছিল। এ দেনা এলসি সংক্রান্ত নয়। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক এমন তথ্য পেয়ে থাকে সেটা এসআইবিএল ও বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝবে।’
ভুয়া এলসি খুলে ঋণ জালিয়াতির ঘটনা অবহিত করা হলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যদি বিষয়টি সত্যি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে দ্রুত গতিতে তদন্তে নামতে হবে।’
তিনি বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি নিয়ে খবর বের হচ্ছে। এসব বিষয়কে আমলে নিয়ে ব্যাংকগুলো বাঁচানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ লাখ লাখ মানুষ এসব ব্যাংকের আমানতকারী। যদি একের পর ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটতেই থাকে তাহলে ব্যাংকিং সেক্টরে বড় ধরনের ধস নামবে। ব্যাংকের বিপর্যয় রোধে এখনই ঋণ জালিয়াতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সূত্র : নতুন সময়