11.6 C
Toronto
মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩, ২০২৪

আরাকান আর্মি কারা, তারা কি চায়?

আরাকান আর্মি কারা, তারা কি চায়?

আরাকান আর্মি সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আরাকান জাতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া দরকার।

- Advertisement -

আরাকান কারা?
ভাগ্যদুর্বিপাকে বার্মা তথা মিয়ানমারের দখলে চলে যাওয়া আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যটি আসলে একটি স্বতন্ত্র দেশ এবং রোহিঙ্গা বা আরাকানিরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। মধ্যযুগীয় আমলে, আরাকান রাজ্য (স্থানীয় নাম ম্রাউক-উ’র রাজ্য) ছিলো আজকের মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে অবস্থিত একটি উপকূলীয় রাজ্য। যা প্রায় ৩৫০ বছর ধরে বিদ্যমান। এটি বঙ্গোপসাগরের পূর্ব উপকূলের কাছে ম্রক-উ শহরে অবস্থিত।

উপকূলীয় রাখাইন প্রদেশ অতীতে স্বাধীন আরাকান রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিলো। ১৮ শতকে বার্মিজদের আগ্রাসনে অঞ্চলটি সার্বভৌমত্ব হারায়। তারপর থেকে চলছে সার্বভৌমত্বের লড়াই। বর্তমান রাখাইন, মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত একটি প্রদেশ। এর উত্তরে চীন, পূর্বে ম্যাগওয়ে অঞ্চল, ব্যাগো অঞ্চল এবং আয়েইয়ারওয়াদি অঞ্চল, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ। আরাকান পর্বতমালা দিয়ে এটি মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা। রাখাইন রাজ্যের আয়তন ৩৬ হাজার ৭৬২ বর্গকিলোমিটার; রাজধানীর নাম সিত্তে।

আজকের নির্যাতিত আরাকানের মুসলমানদের রয়েছে গৌরবময় অতীত। একসময় আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রায় ফারসি ভাষায় লেখা থাকতো কালেমা।

আরাকান রাজদরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাঙলার সঙ্গে আরাকানের ছিলো গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক।

১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে চলে আসেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে তাকে বিতাড়নকারী বর্মি রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা ইসলাম কবুল করেন ও মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে। এর ফলে সেখানে মুসলিম ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, কবি ও শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি পায়।

নামকরণ :
ধারণা করা হয় রাখাইন শব্দটি এসেছে পালিশব্দ ‘রাক্ষপুরা’ (সংস্কৃত: রাক্ষসপুরা) থেকে। যার অর্থ রাক্ষসদের দেশ। খুব সম্ভবত এই অঞ্চলে বাস করা নেগ্রিটো অধিবাসীদের জন্য এই নাম দেওয়া হয়। রাখাইন রাজ্য নিজেদের ঐতিহ্য এবং নৈতিকতা ধরে রাখতে এই নামটিই বহাল রেখেছে। তাদের ভাষায় রাখাইন শব্দের অর্থ, যে নিজের জাতিসত্তা ধরে রাখে। রাখাইন ভাষায় তারা তাদের দেশকে রাখাইনপ্রে। রাখাইন আদিবাসীরা অবশ্য বলে রাখাইনথা।

ধারণা করা হয় যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে ‘রাখাইন’ নামটি পর্তুগিজ অপভ্রংশে ‘আরাকান’ নামে পরিবর্তিত হয়, যা এখনো ইংরেজিতে সমানভাবে জনপ্রিয়।

আরাকান আর্মি :
আরাকান আর্মি(এএ) রাখাইন(আরাকান) রাজ্যভিত্তিক একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করেছে মিয়ানমার। আরাকান আর্মি; ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ইউএলএ)-এর সামরিক শাখা।

আরাকান আর্মির কার্যক্রম মূলত রাখাইন ও চীন রাজ্যকেন্দ্রিক হলেও; দলটি গঠিত হয়েছিল চীন সীমান্তবর্তী কাচিন রাজ্যে। তাদের সহায়তা করে আরেক সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাচিন ইন্ডিপেন্ডেস আর্মি।

আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তুলে আরাকান আর্মি গঠিত হয় ১০ এপ্রিল, ২০০৯ সালে। ২৬ জন পুরুষকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয় আরাকান আর্মির। শুরুর দিকে ছিলো রাখাইন তরুণ ও ছাত্রদের একটি ছোট দল। রাখাইন নৃগোষ্ঠীর (আরাকানি) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই সংগঠন; নিজেদের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে সামনে আনতে চায়।

মিয়ানমারের উত্তরে চীন সীমান্তবর্তী কাচিন রাজ্যে, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআই)-এর সহায়তায় এই দলটি গঠিত হয় এবং সেখানেই তারা প্রশিক্ষণ নেয়।

বর্তমানে এটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বয়সে তরুণ কমান্ডার ইন চিফ মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং (তুন ইয়াত মাইং)। ভাইস ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিয়ো টোয়ান আং।

প্রাথমিকভাবে তাদের রিক্রুটরা ছিলো অভিবাসী রাখাইন শ্রমিক, যারা কাচিন রাজ্যের পাকান্ট শহরে জেড পাথরের খনিতে কাজ করতো। প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নেওয়া হয় চীন সীমান্তবর্তী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির দখলে থাকা একটি অঞ্চলকে। ক্রমাগত বিস্তৃত হতে থাকে সংগঠনটি। বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা।

এরপর ধীরে ধীরে রাখাইন রাজ্য ও ইয়াংগুন থেকে রাখাইনরা কাচিন রাজ্যে গিয়ে আরাকান আর্মির সাথে যোগ দিতে শুরু করে। সেসময় কেআই-এর পাশাপাশি উত্তর মিয়ানমারের অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপের কাছ থেকেও তারা অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা পায়। অনেকের ধারণা, এই মুহূর্তে তাদের সদস্য সংখ্যা ৩ হাজার। আবার কেউ মনে করে, আরাকান আর্মির বর্তমান সদস্য ৭ হাজার।

অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও আরাকান আর্মির সামরিক শক্তি বাড়ানোর প্রচেষ্টা প্রতিহত করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

তবে সব মহল এটা মানেন যে, সামরিক শক্তি নয়, তাদের প্রকৃত অস্ত্র আরাকানের জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন। সে কারণে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংগঠনের সঙ্গে শক্তির লড়াইয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বেগ পেতে হয়। এজন্য প্রায়ই সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটে থাকে।

আরাকান বা রাখাইন হলো মিয়ানমারের অন্যতম দরিদ্র প্রদেশ। বিশ্ব ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ১৭ শতাংশ বাড়িতে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা রয়েছে। মিয়ানমারের অন্য যেকোনও প্রদেশের সাপেক্ষে যা অতি সামান্য। জরিপের তথ্য অনুযায়ী প্রায় তিন লাখ বাড়িতে টয়লেট নেই!

এই যে দিনের পর দিন, অবহেলিত জনপদ। আরাকান আর্মি সংগঠিত হওয়া এবং সম্প্রসারণে এসব নানা কারণও জোরালো ভূমিকা রেখেছে বলেই মনে করেন অনেকে। সার্বিক দিক বিবেচনায় দিন দিন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত রাজ্যটিকে স্বাধীন করতে ভয়ানক হয়ে উঠছে ‘আরাকান আর্মি’। অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার এই ‘আরাকান আর্মি’ সংগঠনটিকে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাই মিয়ানমার এই গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ইতোমধ্যে রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অভিযান চালাতে সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। ফলে ক্রমেই ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে রাখাইন।

২০১৫ সাল থেকে তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাদের রাখাইন রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী চীনে পাঠানো শুরু করে। পরের তিন বছর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সশস্ত্র সংঘাত অব্যাহত থাকে। ২০১৯ সালে এসে বিচ্ছিন্ন সংঘাত অবশেষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। প্রায় দুই বছর যুদ্ধের পর ২০২০ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় আরাকান আর্মির।

রাখাইন রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে আরাকান আর্মির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নতুন সদস্য নিয়োগ করা এবং আর্মির মতাদর্শ প্রচার করায়, সোশ্যাল মিডিয়াকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে আরাকান আর্মি। এজন্য অপেক্ষাকৃত নতুন সংগঠন হলেও আরাকান আর্মির সোশ্যাল মিডিয়া কার্যক্রম অল্পসময়েই রাখাইন তরুণদের মধ্যে আরাকান আর্মিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।

আরাকান আর্মিতে নারীদের অংশগ্রহণের সংখ্যাও কম নয়! বর্তমানে অনেক রাখাইন পরিবারই তাদের সন্তানদের আরাকান আর্মিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টিতে অখুশি নয়!

রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় মূলত আরাকান আর্মির আধিপত্য রয়েছে। আর বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে আরাকান আর্মি। রাখাইন রাজ্যের দক্ষিণের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় মূলত বার্মিজ বামার জনগোষ্ঠীর বাস, যেখানে আরাকান আর্মি ততটা শক্তিশালী নয়।

রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আরাকান আর্মির অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।

তবে তাদের কমান্ডার ২০২১ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে; রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মির প্রশাসনিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।

আরাকান আর্মির উদ্দেশ্য :
বহু-জাতিগত আরাকানি জনসংখ্যার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ, আরাকান জনগণের জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও প্রচার এবং আরাকান জনগণের ‘জাতীয় মর্যাদা’ এবং সর্বোত্তম স্বার্থের পক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছে তারা।

২০২১ সালের আগস্টে পরিচালিত আরাখা মিডিয়া (একেকে) এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে, আরাকান সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো আরাকানের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা; এতে কোনো দর কষাকষি হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles