বিকালে বাসায় ফিরে ভাতের থালা হাতে নিউজের সামনে বসি।
চীন এর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দুই মাইকেল কানাডায় নামার দৃশ্য দেখাচ্ছে। আমাদের প্রাইম মিনিস্টার এক মাইকেলকে সেই যে জড়িয়ে ধরলো, আর ছাড়াছাড়ি নাই।
আবেগে চোখ মুছতে মুছতে গিন্নিকে ডাক দিলাম- কোই গেলা.. দেখো তোমার ট্রুডোর কান্ড। সেই যে ধরছে, আর ছাড়াছাড়ি নাই। খাঁটি ভালোবাসা গো.. ভোট তো এমনি এমনি পায় না..
ট্রুডো বলতে গিন্নি অজ্ঞান। সে দৌড়ে এসে কিছুক্ষন টিভির দিকে তাকিয়ে বলল- চান্দু, টিভি যে হ্যাং হয়ে আছে টের পাইছো? মডেম রিস্টার্ট দাও, ট্রুডো ছেড়ে দেবে
– আমি ভাবছিলাম..
– তুমি তো কত কিছুই ভাবো। খাওয়া শেষ করে, চোখ মুছে রান্না ঘরে আসো। পিঁয়াজ কাটতে হবে..
.
রান্নাঘরে পিঁয়াজ কাটা, বাসন মাজতে গেলেই আমার মাথায় নানান বিজনেস প্ল্যান ঘুরপাক খায়। তখন বন্ধুকে না বলা পর্যন্ত পেটের বিরিয়ানী হজম হয় না। ফোন দিয়ে বললাম, দোস্ত ভালো আছিস?
– কী কাকতালীয়! তোকেই ফোন দিতে যাচ্ছিলাম। বল..
– আগে তুই বল
– তুই ফোন করছিস তুই বল
– না তুই বল
– বুকা..বল!
– তুই আগে..
– হারামি বলবি না?
– একটা ব্যবসার আইডিয়া ছিল..
– কিসের?
– বাংলাদেশে হোটেল বিজনেস করবো। খামোখা কানাডায় এতগুলা বছর নষ্ট করলাম
– ভাতের হোটল?
– নাহ..থাকার। নতুন এডভেঞ্চার! মানুষ থাকবে মাটির কুঁড়ে ঘরে, গ্রাম্য পরিবেশে, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনবে, নারকেল পড়ার শব্দে ভয় পাবে..
– এগুলা অলরেডি বাংলাদেশে দশ বছর আগে শুরু হয়ে গেছে। ঢোল কলমির বেড়া দেওয়া, মাটির বাড়ির ব্যবসা জমজমাট। মানুষ ফাইভ ষ্টার হোটেলের থেকেও বেশি পয়সা খরচ করে হাইটেক কুঁড়ে ঘরে থাকা শুরু করছে
– আমারটা হবে অরিজিনাল। গরিব মানুষের ইউজড। ভাঙা জানালা, ছেঁড়া ফাটা তোষক, তেল চিটচিটে বালিশ, পর্দা, পুরানা ক্যালেন্ডার কিনে সাজাবো। শিঁকেয় তোলা থাকবে মুড়ি, গুড়, বাতাসা
– হুমম.. তারপর?
– ছালা দিয়ে ঘেরা পায়খানার নিচে থাকবে মাটির চারি। কাজ সারতে সারতে মেঘ দেখবে, পাখির গান শুনবে! কেউ আসলে কাশি দিয়ে জানান দিবে। গুঁই সাপ ঘোরাঘুরি করবে। চারি ভরলে মেথর এসে মাথায় করে নিয়ে যাবে
– ইন্টারেস্টিং!
– সাবান, শ্যাম্পু, পেস্ট হারাম। বাথরুমে হাত ধোবার জন্য থাকবে ছাই, দাঁত মাজার জন্য কয়লা। কেউ লুকিয়ে ইউজ করলে এক হাজার টাকা ফাইন
– ভালো!
– কোয়াক ডাক্তার সাইকেলে করে ভিজিটে আসবে; শুধু জ্বর আর পাতলা পায়খানা হলে। ইমার্জেন্সী না হলে হাসপাতাল হারাম। মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ অফিসে জমা দিয়ে ঢুকতে হবে
– খাবেটা কী?
– বিল, পুকুর থেকে মাছ মেরে আনা হবে। কাজের বুয়া কুটবে, খড়ির চুলায় রান্না করে টিনের থালায় খাওয়া
– এক্সসেলেন্ট!
– গোয়াল ঘরে গাভীকে দুধ দোয়ানো হবে। সেটা দুধ পিঠা বানানো হবে। ফকির আসবে ভিক্ষা করতে
– ফকির কোই পাবি!
– বেতন দিয়ে রাখবো। চোরও পাঠানো হবে
– কেন?
– চুরি করতে যাবে, গেস্টরা ভয়ে চেঁচাবে! অন্যরকম থ্রীল!
– খোদার কসম, আমার এক্ষুনি যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। ফাটাফাটি চলবে। তোর যে কোনো হেল্প লাগলে বলিস, আমি আছি
– থ্যাঙ্ক ইউ!
– রিপন রে, একটু বিপদে পড়ছি। একটা কাজ পারবি?
– শিওর!
– তুই ছাড়া ওখানে আর রিলায়েবল কে আছে বল? আমার পক্ষে অটোয়া যাওয়া সম্ভবই না
– বলেই দেখ!
– আমার এক পরিচিত ভাগ্নির বিয়ের কথা চলছে। ছেলে দেখতে যেতে হবে। অনেকেই তোকে চিনে
– তোর দোয়ায়.. কবে?
– আজকে সন্ধ্যায়। আমার পক্ষের চারজন, তোকে দিয়ে। আর ছেলে পক্ষের চারজন, ছেলে সহ। ইজ্জত রাখিস
– শিওর!
– মনে রাখিস, তুই ভালো বলা মানে ফাইনাল। হাক্কা চাইনিজে মিটিং হবে। এই সুযোগে ইচ্ছেমত স্যুপ, রাইস মেরে দিয়ে আসবি। লজ্জা করবি না
– ওকে
– আর সাবধান, তোর আওয়াজ করে স্যুপ খাওয়া দেখলে বিয়ে মাঠেই মারা যাবে। মইষের মতো খাবি না। বিলটা অবশ্যই তুই দিবি। পরে তোকে টাকা ইন্টেরেক্ট করে দিবো
– বিল নিয়ে কোনো চিন্তা করিস না
– আর রেস্টুরেন্ট কেমন আমাকে জানাস তো? দরকার আছে
– ওকে।
আমি রেডি হয়ে সন্ধ্যায় বের হতেই গিন্নির প্রশ্ন, আতর মেখে কোই যাও?
– একটা বিয়ের প্রস্তাব ফাইনাল করতে
– তুমি এত ইম্পর্ট্যান্ট কবে হইলা? তোমার ঘটকালি করা কোন বিয়েটা টিকছে? তোমার কাজই হলো কার্গিল যুদ্ধ বাধানো। বৌ-জামাই খুনোখুনি হতে শুধু বাকি থাকে। একবার হুমকি খাইছিলা মনে নাই? জীবন নিয়ে টানাটানি
– আজকেরটা ভালো..
– চান্দু, একটা বিজনেস আইডিয়া আসলো মাথায়
– বলো বলো!
– তোমার নাম চেঞ্জ করে ‘পাখি রিপন’ রাখো। হোটেল/মোটেল বাদ। ঘটকালি ব্যবসায় অনেক পয়সা
– বলছো!
– তবে আর কী! বিয়ে টিকলো না টিকলো, এইটা নিয়ে আসলে টেনশন করে লাভ নাই। বিয়ে দিয়ে পগার পার! আর শোনো চান্দু, আগে ঘটকালি করে অলরেডি তিনটা পাঞ্জাবি আর দুইটা স্যুট পাইছো। এইবার শীতকালের জন্য ভালো একটা জ্যাকেট নিও তো.. আর স্নো বুট?
– খারাপ বলো নাই..
আজকে আমার বন্ধুর ফোন। ভাঙা গলায় বলল- রিপন, তুই ছেলে দেখতে গেছিলি, না খাইতে?
– ক্যা?
– ছেলে তো পুরা ফোর টুয়েন্টি রে!
– মানে?
– মানে আর কি.. ঢাকায় আগের বৌ আছে, বাচ্চা আছে। শ্বশুর-শাশুড়ি, শালা-শালী, ভায়রা-সুমন্ধি সব আছে
– বলিস কি!
– আমার তিনশো ডলার পানিতে। বুকা..
.
পাশ থেকে গিন্নি বলল, কী হইছে?
– ঘটনা বেগতিক। ছেলের না কি ঢাকায় সংসার আছে!
– কালকে চিশতী ভাইকে যে বললা ছেলে ফাইভ স্টার?
– ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পারি নাই। ভাবছিলাম..
– কী ভাবছিলা?
আমি আর উত্তর দিতে পারি না। দুঃখের কথা কেমনে বলি? ভাবছিলাম চিশতী চাইনিজ স্যুপের কথা জিজ্ঞেস করছে।
যে স্বাদের ছিল ভাই রে..
অটোয়া, কানাডা।