1.8 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

প্রবীণনিবাস

প্রবীণনিবাস - the Bengali Times
ছবি ম্যাট বেনেথ

জোবেদা বেগম। ছোটখাটো একজন মানুষ। ঘাড় অবধি ছাটা চুল। ম্যাক্সির উপরে চাদর জড়ানো। চেহারার মাঝে দুঃখের ছাপ সুস্পষ্ট। মলিন হাসি নিয়ে চেয়ার টেনে আমার পাশে বসলেন। আমি বসে ছিলাম লীলা বড়ুয়ার কামরাটিতে। বড় হাসিখুশি মানুষ লীলা বড়ুয়া। জীবন সর্ম্পকে তার কোনো অভিযোগ নেই। আমার মতো একজন অপরিচিত মহিলার সাথে কথা বলতেও তার আগ্রহের শেষ নেই। পা ভেঙে পড়ে আছেন বিছানায়। কাজের মেয়ে আছে একটি সেই তাকে আপাততঃ দেখা-শোনা করছে। একমাত্র মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। স্বামী বিয়োগ হয়েছে বহু বছর। একা বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ বোধ করছিলেন না। চাঁদাবাজদের আনাগোনা। সংখ্যালঘু একজন বৃদ্ধার এত টাকা পয়সার কি প্রয়োজন? নানারকম উৎকট ঝামেলার শিকার হয়ে তিনি এই স্থানটি বেছে নিয়েছেন। তবে ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা খোঁজ খবর নেয়, দেখাশোনা করে। এতেই তিনি অনেক খুশি।

আমি বসেছিলাম শেরে-বাংলা-নগরের প্রবীণ নিবাসটির লীলা বড়ুয়ার কামরায়। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে কত গান, কত কবিতা, কত ব্যথাভরা কাহিনী, কত বিজ্ঞাপন। এইসব কিছুর মাঝে ইতিবাচক কিছু নেই, শুধুই নেতিবাচক। সে সব কারণে আমার দেশে গিয়ে ইচ্ছে হলো একবার ঘুরেই আসি না কোনো এক বৃদ্ধাশ্রম থেকে। আমার পাশে বসা জোবেদা বেগমের কাছ থেকে কথাচ্ছলে নানা কথা জানতে চাইলাম কিন্তু তিনি মৃদু হাসি ছাড়া আর কিছুই আমার সামনে তুলে ধরলেন না। তার হয়ে কথা বললেন লীলা বড়ুয়া আমার সাথে। জোবেদা বেগমের সবই ছিল, স্বামী-সন্তান, বাড়িঘর, স্বামী অনেক উচ্চপদের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের করুণ পরিহাস। স্বামী গত হলেন। ছেলে বিদেশে, মেয়ে ঢাকা শহরেই আছে। বাবার মৃত্যুর পর ছেলে-মেয়েরা বাড়িটি বিক্রি করে দেয়। সন্তানরা নিজেদের টাকা পয়সা ভাগাভাগি করে নিয়ে মাকে দুই আনার অংশ দেয় আইন অনুযায়ী। জোবেদা বেগমের থাকার আর কোনো জায়গা থাকলো না। দুই আনা সম্পত্তির টাকাই তার সম্বল। তা দিয়েই তিনি চলছেন। আর বৃদ্ধাশ্রমই হয়েছে তার বর্তমান ঠিকানা। মেয়ে আসে কখনো সখনো দুই প্যাকেট বিস্কুট কিংবা কয়েক প্যাকেট চিপস্ হাতে নিয়ে। জোবেদা বেগম মাথা নিচু করে লীলা বড়ুয়ার মুখে নিজের জীবন কাহিনী শুনছিলেন। আমিও ভারাক্রান্ত মনে কোনো এক করুণ গল্প শোনার মতো জোবেদা বেগমের কাহিনী শুনছিলাম। মনে মনে ধিক্কার দিচ্ছিলাম তার সন্তানদের।

- Advertisement -

লীলা বড়ুয়ার ঘর থেকে বের হয়ে এগিয়ে গেলাম আরেকটি কামরার দিকে। লাইন ধরে তিনটি করে কামরা তিনজনের জন্য। আর তিনজনের জন্য পাশাপাশি একটি গোসলের ঘর আর একটি টয়লেট। তিনজন মহিলা তা শেয়ার করেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নির্ধারিত লোক আছে। যদিও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার নিঁখুত কোনো ছবি আমার চোখে পড়লো না। কিছুটা অবহেলিত মনে হলো সবকিছুর দিকে তাকিয়ে। এভাবেই তিনটি করে কামরা একেক সারিতে। প্রবীণ নিবাসটিতে সেদিন যিনি সঙ্গী ছিলেন তার পরিচিত ছিল পরবর্তী রুমের বাসিন্দাটি। তিনি তার নাম ধরে ডেকে দরজায় টোকা দিলেন। রুমের ভেতর থেকে সাড়া এলো, ‘ভেতরে আসুন দরজা খোলা আছে।’ ভেতরে ঢুকে যাকে দেখলাম তিনি অত্যন্ত পরিপাটি একজন মহিলা। সদ্য স্নান সেরে এসেছেন। কাঁচা-পাকা ভিজে চুল পিঠে ছড়ানো। টানটান করে শাড়ি পড়া। চশমা চোখে। ছোট ঘরটি অত্যন্তÍ গুছিয়ে রেখেছেন। বসে টেলিভিশন দেখছিলেন। ঘরে ছোট একটি টেলিভিশন নিজের খরচে কিনে নিয়েছেন। তার ঘরটির পাশেই ব্যালকনি। নানারকম ফুলের গাছ টবে লাগিয়ে সাজিয়েছেন ব্যালকনিটি। আমার পরিচয় দিলেন আমার সঙ্গী। এতে উনি খুব প্রীত হলেন না বুঝতে পারলাম। জিজ্ঞেস করলাম ‘কেমন আছেন’? তিনি অত্যন্তÍ দৃঢ়ভাবে জবাব দিলেন ‘খুব ভালো আছি’। তিনি একজন কলেজ শিক্ষিকা ছিলেন। দুই একটা বইও লিখেছেন। তাকে বেশি প্রশ্ন করার সুয়োগ আমি পাইনি। বরং তিনিই আমাকে হাজারো প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে লাগলেন। সমাজ সংসার, দেশ রাজনীতি, প্রবাস জীবন বহুকিছু নিয়ে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব তিনি দিলেন না। কথা শুনে মনে হচ্ছিল জীবন সম্পর্কে অনেক অভিমান পুঞ্জিভুত হয়ে আছে তার। আবার বললেন, এখানে তিনি নিজের মতো নিজের স্বাধীনতা নিয়ে থাকতে পারছেন এর চাইতে বেশি জীবনে কিছু চাওয়ার নাই। এই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে আমার মনে হচ্ছিল মহিলা মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। সেটা হয়তো নিজের জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি অনিহার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। সন্তানদের কথা কিছুই বলতে চাইলেন না তিনি। বুঝতে পারলাম সন্তানদের প্রতি প্রচণ্ড অভিমান। সন্তানদের অবহেলা হয়তো তাকে এখানে আসতে বাধ্য করেছে। শুভকামনা জানিয়ে বেরিয়ে আসার পথে চোখে পড়লো একজন সুদর্শন পুরুষের সাথে তার ছবি দেয়ালে টানানো। তিনি নিজ থেকেই বললেন তিনি তার স্বামী। কিন্তু তিনি এখন বেঁচে নেই। বেরিয়ে আসার সময় মনে হলো তিনি কিছুটা আবেগকাতর হয়ে পড়েছেন। সজল চোখে বললেন ‘আপনি কিন্তু আবার আসবেন। আর আসার সময় আপনার লেখা বইগুলো আমার জন্য নিয়ে আসতে ভুলবেন না যেন।’ আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম যদিও আমি আমার কথা রাখতে পারিনি।

আবারও এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। চোখে পড়লো রান্নাঘরটি। মাঝারি আয়তনের রান্নাঘরটিতে তিনজন মহিলা কাজ করছে। একজন সবজি কাটছে, একজন মাছ ধুচ্ছে, আরেকজন মাংস চড়িয়েছে উনুনে। ওরা জানালো আজ দুবেলার জন্য রান্না হবে, সবজি, মাছ ডাল ও মাংস। একটি ছোট খাবারঘরও চোখে পড়লো। যাদের ইচ্ছা তারা সে রুমে বসে খান, আবার কারো ইচ্ছা হলে খাবার নিজের ঘরে নিয়েও খেতে পারেন। সব ঘরেই খাবার খাওয়ার উপযোগী টেবিল চেয়ার ও একটি করে ছোট ফ্রীজ দেখলাম।

নানা ঘরে ঘুরতে ঘুরতে একটি খোলা বারান্দার মতো জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। এই জায়গাটি পেরিয়ে আশ্রমটির একপাশ থেকে অন্য পাশে রুমগুলোতে যাওয়ার ব্যবস্থা। খোলা জায়গাটিতে ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে। একপাশে ছোট করে একটি রান্নার ব্যবস্থা। যারা শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার জন্য সব রকম খাবার খেতে পারেন না সেরকম দুজনকে দেখলাম নিজেরা রান্না করছেন। বিল্ডিংটির দুটি প্রান্ত এবং দুপ্রান্তের দৃশ্য ভিন্ন। একপাশে দেখে আসলাম জীবনের প্রতি অনিহা অভিযোগের চিত্র বিরাজমান। আরেকদিকে প্রাণোচ্ছ¡ল ভাব। খোলা জায়গাটিকে কয়েকজন প্রবীণ নারী পুরুষ বসে গল্প করছেন। কথা হলো সায়লা বানুর সাথে। অত্যন্ত হাসিখুশি একজন মানুষ। প্রবীণ নিবাসে থাকার ব্যাপারটা তিনি খুবই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। আশ্রমের এই পাশটা অনেকটাই খোলামেলা। থাকার রুমগুলোও বেশ বড় মাপের। সব ঘরের সাথে আলাদা সংলগ্ন বাথরুম। এই পাশের বাসিন্দারা অনেক আগে এসেছেন বলে ভালো দিকটা তারা পেয়েছেন এবং এদিকের ভাড়াও বেশি। সায়রা বানুর ঘরে বড় মাপের ফ্রীজ টেলিভিশন। অবশ্য তিনি নিজের পয়সায় কিনে নিয়েছেন, এসব জিনিশ। দেখেই বোঝা যায় এপাশের বাসিন্দারা অনেকটাই সচ্ছল। সায়রা বানুর পাশের রুমটিতেই থাকেন জব্বার সাহেব। দুজনের মাঝে বেশ সখ্যতা অনুভব করলাম। সায়রা বানুকে প্রবীণ নিবাসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করাতে তিনি খুব হাস্যোজ্জ্বল মুখে জবাব দিলেন, ‘আমি একা মানুষ, একটিই মেয়ে সে থাকে বিদেশে। কী করে বাড়ি পাহারা দিয়ে বসে থাকি বলুন? চোর ডাকাত, কাজের লোকের ঝামেলা, একা থাকার নিরাপত্তাহীনতা। এই এখন এটাই আমার বাড়ি। কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। বাইরে যেতে হলে রুমটিতে তালা ঝুলিয়ে চলে যাই। আবার ফিরে এসে নিজের ঘরে ঢুকে যাই।’ কথা শেষ করে শব্দ করে হেসে উঠলেন তিনি। ভালো লাগলো সায়রা বানুর ইতিবাচক মনোভাব দেখে। আরো বেশ কিছু প্রবীণজনের সাথে বাক্য বিনিময় হলো। কাউকেই তেমন অসুখী মনে হলো না। দেখা হলো চিরকুমারী রমা দাশের সাথে। তিনি কেবলি বাইরে থেকে ফিরেছেন। গলায় প্রবীণ নিবাসটির ঠিকানা নিজের নাম একটি কার্ডে ঝুলালো। বাইরে গেলে সেটাই নিয়ম হয়তো নিরাপত্তার কারণে। শক্ত সামর্থ মহিলা এই রমা দাশ। একা থাকার নানারকম অপ্রিয় ঝামেলা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এই প্রবীণ নিবাসটিতে তার উঠে আসা। একপাশে রয়েছে মিটিংরুম। চারপাশে চেয়ার বিছানো। বড় স্ক্রিনের টেলিভিশন রয়েছে ঘরটিতে। বিকেলে সবাই সেখানে মিলিত হন। নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হাসি গল্প হয়। নিবাসটির সংলগ্ন তাদের নিজস্ব হাসপাতাল। রোগী দেখার জন্য ডাক্তারের চেম্বার। সেখানে খুবই সামান্য মুল্যে চিকিৎসা এবং ঔষধ দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে এই প্রবীণ নিবাসটি সরকারি অনুদানে চললেও একেবারে ফ্রি না। থাকা খাওয়ার জন্য সামান্য কিছু ফি দিতে হয়। কাজেই হতদরিদ্র বৃদ্ধাদের স্থান এই নিবাসটি না। তবে এই নিবাসটির বাইরের প্রবীণরাও এখানে স্বল্প মুল্যে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন। তবে সে জন্য তাকে নিবাসটির কার্যকরী কমিটির সদস্য হতে হবে। প্রবীণদের রুমে ঢোকার আগে এই নিবাসটির নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ে গিয়েছিলাম এখানকার নিয়ম কানুন এবং আমাদের প্রবেশের অনুমতি আছে কি-না জানার জন্য। সবার কাছ থেকেই অত্যন্ত ভদ্র এবং অমায়িক ব্যবহার পেয়েছি। তাদের মাঝে একজন বলে উঠলেন, কাল আপনাকে টিভিতে দেখেছি সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। আপনি তো লেখিকা তাই না? তার কথায় সেদিন খুব বিব্রত এবং সংকোচবাধ করছিলাম। তাদের কাছেই জানতে পারলাম এই প্রবীণ নিবাসটিতে এখন পয়তাল্লিশজন প্রবীণ আছেন।

যতটা মন খারাপ হবার দৃশ্য দেখবো বলে ভেবে গিয়েছিলাম, সেরকম কিছু আমার মনে হলো না। বরং মনে হলো ছেলে-মেয়েদের কাছে অবহেলিত বা নিরাপত্তা হীনতায় জীবন কাটানোর চাইতে প্রবীণ বা বৃদ্ধাশ্রম যাই বলি না কেন সেটা অনেক উত্তম স্থান। সন্তানদের আদর-ভালোবাসা, নাতি-নাতনীর কোলাহল থেকে বঞ্চিত হলেও এবং বুকের ভেতর জমা ব্যথা লুকিয়ে থাকলেও, তবুও বললো তারা সমবয়সীদের নিয়ে ভালোই আছেন। নিরাপদে আছেন। নিজের স্বাধীন মতো আছেন। কর্তৃপক্ষ যদি পরিষ্কার পরিচ্ছতার প্রতি আরো কিছুটা সচেতন হন তাহলে এইসব বৃদ্ধাশ্রম আরো সুন্দর হয়ে উঠবে। আমরা সারাক্ষণই বৃদ্ধাশ্রম ভাবতেই একটা করুণ চিত্রের অবতারণা করি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো সেটা সঠিক না। সবকিছুর মাঝে ইতিবাচক কিছু খুঁজে নিতে পারলে হয়তো জীবনে অনেক কম কষ্ট পেতে হয়।

আমরা যারা প্রবাসে বসবাস করছি তাদের অনেকের ঠিকানাই হয়তো হবে ওল্ড হোম। এতে বিচলিত হবার কিছু নেই। একাকীত্ব, খালি বাড়িতে শারীরিক কারণে কিংবা অন্যান্য কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার চাইতে ওল্ড হোমে নিরাপদে থাকাটা কোনো লজ্জা বা অনুশোচনার ব্যাপারই না। জীবন যেখানে সুন্দর থাকবে, ভালো থাকবে, সে স্থানটিই বেছে নেয়া কি ভালো না?

ম্যাল্টন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles