5.8 C
Toronto
শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

ইউক্রেন এবং আমাদের রাজনীতি

ইউক্রেন এবং আমাদের রাজনীতি
ফাইল ছবি

ইউক্রেন নিয়ে গোটা বিশ্ব যখন তোলপাড়, মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু, ঠিক সেই সময়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্যে নড়ে চড়ে বসা দলগুলোর তৎপরতা। অথচ ভাবতে অবাক লাগে যে দেশের রাজনীতি ও নেতারা বিগত ত্রিশ বছর যাবত যে খোলসে বন্দী ছিলেন সেখান থেকে এক পা এগুতে পারেন নি।

অথচ একই সময়কালে প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্ব রাজনীতি, রাজনীতির নিয়ামক শক্তিগুলোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের মত স্থবির বসে নেই। আসুন দেখি কদিন আগে ভারতের কয়েকটি প্রদেশের নির্বাচনে কী ঘটনা ঘটে গেল! উত্তর প্রদেশ সহ বিভিন্ন জায়গায় মোদীর সাম্প্রদায়িক দল জয় পেলেও পান্জাবে ঘটেছে অন্যরকম ঘটনা। যেখান থেকে বাংলাদেশের নেতাদের শেখার রয়েছে অনেক কিছু।
ভারতের অন্যতম চেইন্জ মেকার পলিটিশিয়ান অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমী পার্টি দিল্লীর পর এবার পান্জাবে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। যারা রাজনীতির অ আ ক খ খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন যে রাজনীতিতে সফলতা পেতে কেজরিওয়ালকে দুটো প্রচলিত তথাকথিত ধারা ফলো করতে হয় নি। পারিবারিক উত্তরাধিকার সুত্রে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করার মত রাজনীতির মসনদ দখল করার সুযোগ তার ছিলই না, আবার তাকে কোন ধর্মীয় বা ঘৃনিত সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে নিরীহ জনগনের রক্তের হোলি খেলা করেও সফলতা তাকে আনতে হয় নি। কেজরিওয়ালের সামনে একটিই পথ খোলা ছিল তা হলো সত্যিকারের পরিবর্তন।

- Advertisement -

২০১৩ সালে দিল্লীর প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি মাত্র ২৯টি সীটে বিজয়ী হয়ে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সেখানে সরকার গঠন করেন। কিন্তু মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় তিনি পদত্যাগ করে রাস্তার মানুষ আবারও রাস্তায় চলে আসেন। ২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় সংসদ বা লোকসভা নির্বাচনে দিল্লীর সাতটি সীটে প্রতিদ্বন্দিতা করে তার দল সবকটিতে পরাজিত হয়।

তখন তার নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে। দিল্লীর লোকসভা নির্বাচনে চরমভাবে পরাজয়ের পরে সবাই ভেবেছিল তার চটকদার বিপ্লবী কথাবার্তার দিন শেষ, তাকে দিয়ে আর কিছু হবে না। এরপর একটি মামলায় জামিন না নেবার অভিযোগে তাকে আটক করা হলো, তাকে দিল্লীর তিহার জেলে নেয়া হলো। নরেন্দ্র মোদী বিপুল ভোটে লোকসভা নির্বাচনে জিতে আসলেন। পার্টির ৪০০ এমপি প্রার্থীর অধিকাংশের জামানত বাজেয়াপ্ত হলো শুধু দিল্লী আর পান্জাব ছাড়া। আম আদমী পার্টির একটি সুবিধাবাদী গ্রুপ কেজরিওয়ালকে পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। দলের পরাজয়ের জন্য তাকেই দায়ী করা হলো। জামিনে ছাড়া পেয়ে জেল থেকে বের হলেন কেজরিওয়াল, ডাকা হলো পার্টির জাতীয় নির্বাহী কমিটির মিটিং। প্রত্যাশা অনুযায়ী সিনিয়র লিডাররা তাকে পার্টির কনভেনারের পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করলেন। কেজরিওয়াল তার বক্তব্যে বললেন, তিনি পার্টির কনভেনার হবার জন্য রাজনীতিতে আসেন নি। আঝোরে কাঁদলেন কেজরিওয়াল। সেদিনটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে হতাশার দিন। কিন্তু একই সাথে সেটাই ছিল তার জীবনের একটা রুপান্তরকারী মুহুর্ত। তিনি যাদুকরী বক্তব্য দিলেন। তিনি বুঝলেন সাফল্য ছাড়া সফলতা হয় না, অর্থাৎ সফল হবার কোন বিকল্প নেই। সেই দিনের সভা শেষে বের হয়ে এল এক নুতন কেজরিওয়াল। হতাশা, ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে সাহস, আত্ম প্রত্যয়, দৃঢ় বিশ্বাস আর প্রজ্ঞার কেজরিওয়ালের আত্মপ্রকাশ হলো। তার সামনে তখন মাত্র ছয় মাস ছিল দিল্লীর বিধানসভার নির্বাচনে প্রস্তুতি নেবার। সেই নির্বাচনে ভুমিধ্বস বিজয় পেলেন কেজরিওয়ালের আম আদমী পার্টি। ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি আসনেই বিজয় পেলেন কেজরিওয়াল। তখন থেকেই তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। দিল্লীর পর তিনি নজর দিলেন ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও। ২০১৭ সালেন পান্জাবের নির্বাচনে তেমন সফলতা না পেলেও ২০২২ সালে তিনি দিল্লীর বাইরে পান্জাবেও ব্যাপক বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছেন। ২০১৫ সালের দিল্লীর নির্বাচনের মতই পান্জাবের ১১৭টি আসনের মধ্যে তার দল আম আদমী পার্টি বিজয় পেয়েছে ৯৩টি আসনে। ২০১৪ সালের ভারতের সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন প্রদেশে কোন আসন না পেলেও পান্জাবে শতকরা ২৩ভাগ ভোট পেয়ে ৪টি আসনে বিজয়ী হতে পেরেছিল আম আদমী পার্টি। ব্যাপক জনসমাগম লক্ষ্য করা গিয়েছিল তাদের নির্বাচনী সভাগুলোতে। ফলে সবাই ধারনা করেছিল ২০১৭ সালে আম আদমী পার্টি পান্জাবে সরকার গঠনের মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। সেভাবেই তারা গোটা পান্জাবে পুরো দুটো বছর সংগঠিতভাবে পার্টিকে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তার পরেও সেই নির্বাচনে তেমন সফলতা পায় নি তারা। তাদের পরিশ্রম, নেতা কর্মীদের ব্যাপক উৎসাহ সত্তেও মাত্র ২২ ভাগ ভোট পেয়ে তাদের ঝুলিতে আসে ২০টি আসন। এতে তারা এতটাই হতাশ হয়েছিল যে তারা বিজয় মিছিল করতেও ভুলে গিয়েছিল। অথচ একটা নুতন পার্টি হিসেবে তারা প্রথমবারের মত পান্জাব বিধান সভায় নির্বাচন করে ২০টি আসন নিয়ে তারা সেবার প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসতে সক্ষম হয়েছিল।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তারা এতটা আত্মবিশ্বাসের পরও, এত পরিশ্রমের পরও সরকার গঠনের মত বিজয় পায় নি কিন্তু এবার ২০২২ সালে এসে ভুমিধ্বস বিজয় পেতে সক্ষম হলো? এখানেই বাংলাদেশের তৃতীয় শক্তির উণ্থানের প্রত্যাশাকারীদের শেখার বিষয় রয়েছে।

এনডিটিভির একজন লেখকের মতে তিনটি কারণে ২০১৭ সালে তারা সফলতা পায় নি যা তারা ২০২২ সালে এসে শুধরে নিয়েছিল বলেই এবার ব্যপাক বিজয় পেয়েছে দিল্লীর বাইরে পান্জাবের মত একটি প্রদেশে। কারণ তিনটি হলো:

) ২০১৭ সালে আম আদমী পার্টিকে পান্জাবে একটি বহিরাগত দল হিসেবে লেবেলিং করা হয়েছিল। কেননা, তারা দিল্লী থেকে সকল নেতাদেরকেই শুধু পান্জাবে এনে হাজির করেছিল তা নয়, এমনকি দিল্লী থেকে দলীয় কর্মী বা স্বেচ্ছাসেবকদেরকে এনেও পান্জাবের প্রচারে নামিয়েছিল। ফলে পান্জাবের নির্বাচনের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল দিল্লীর নেতাদের হাতে, পান্জাবের নেতাদের ভুমিকা ছিল অনেকটা পুতুলের মত।

২) অনিচ্ছাকৃতভাবে বা না জেনে হলেও আম আদমি পার্টির নেতাদের সাথে পান্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংযোগ ছিল বা সখ্যতা ছিল বলে প্রপাগান্ডা উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। কেননা, একবার অরবিন্দ কেজরিওয়াল পান্জাব ভিজিট করা কালীন এমন একজনের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন যিনি ছিলেন স্বাধীন খালিস্তান নেতা। খালিস্তান আন্দোলনের অনেক নেতার পরিবার পরিজন যারা কানাডা, আমেরিকা বা ইউরোপে থাকেন তাদের সমর্থন ছিল কেজরিওয়ালের প্রতি, ফলে একটা মিথ্যা ধারণা দেয়া সহজ হয়েছিল যে কেজরিওয়ালের পার্টি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থক।

৩) অপর আরো একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় ছিল যে আম আদমি পার্টি তখনো পান্জাববাসীর সামনে এমন কাউকে উপস্হাপন করতে ব্যর্থ হয়েছিল যিনি পান্জাবে পার্টি বিজয়ী হলে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিবেন। ধারনা করা হয়েছিল যে কেজরিওয়াল নিজেই হয়তো মুখ্যমন্ত্রী হবেন অথবা তার পক্ষে কেউ একজন প্রক্সি দিবেন।
কিন্তু ২০২২ সালে এসে তারা এই ভুলগুলো সংশোধন করেন। দিল্লীর নেতা কর্মীদের পান্জাবের নির্বাচনে প্রকাশ্যে আসা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পর্দার অন্তরালে থেকেই কাজ করতে বলা হয়েছিল তাদেরকে। আরো কঠিনভাবে বলা হয়েছিল যাতে কোনভাবেই কারো প্রবাসী বা দেশী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে কোনরকম যোগাযোগ না থাকে। সর্বোপরি পান্জাবের জনপ্রিয় নেতা ভগবান্ত ম্যানকে ভবিষ্যত মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসানো হবে এরকম একটা ধারনা মানুষের সামনে নিয়ে আসা।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, তারা পান্জাবে কেজরিওয়াল মডেল জনগনের সামনে থ্রো করেছিল যারা মুল কথা ছিল তারা নির্বাচনে বিজয়ী হলে সবার জন্যে বিনামুল্যে বিদ্যুত ও পানির ব্যবস্হা করবে যা অনেকটা দিল্লীর মডেলের অনুরূপ ছিল। আর ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টির দলীয় কোন্দল, কনফিউশন, হতাশার বিষয়টিও আম আদমী পার্টির দিকে জনগনের মনযোগ এনে দেবার সুযোগ করে দেয়।

দিল্লীর রাজনীতি আর পান্জাবের রাজনীতি এক নয়। দিল্লীতে যেখানে উদ্বৃত্ত বাজেটে পরিচালনা করা গিয়েছে, সেখানে পান্জাবের অর্থনীতি অনেকটা দেউলিয়া অবস্হানে। এছাড়াও পান্জাবে ধর্ম ও রাজনীতি মিলে মিশে একাকার, ফলে পান্জাব শাসন করা, জনগনের ভাগ্য পরিবর্তন করা একটা অন্যরকম চ্যালেন্জ হবে বলেই ধারণা করা যায়। আরো ধারণা করা যায় এই পান্জাবে আম আদমী পার্টির সফলতার উপর নির্ভর করে ভারতের আগামী দিনের রাজনীতির গতি প্রকৃতি কোন দিকে যাবে। বিশেষ করে যারা পারিবারিক উত্তারাধিকারের বা ধর্মীয় কার্ড খেলার রাজনীতি নয়, শতকোটি মানুষের সত্যিকারের ভাগ্য পরিবর্তনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, তাদের কৌতুহুল দিল্লীর পর এবার পান্জাবে সন্নিবেশিত হবে তা বলাই বাহুল্য।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles