2.1 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

বাসে ক্রুদ্ধ সেই ছাত্রলীগ নেত্রীর শেষপর্যন্ত কী হয়েছিলো?

বাসে ক্রুদ্ধ সেই ছাত্রলীগ নেত্রীর শেষপর্যন্ত কী হয়েছিলো? - the Bengali Times

কিছুদিন আগে বাসের মধ্যে ‘সরকারবিরোধী মন্তব্য’ করার জের ধরে দুই পুরুষ যাত্রীর সঙ্গে এক তরুণীর তীব্র বিতণ্ডার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিলো। ফেসবুক লাইভে ওই তরুণীকে বলতে শোনা যায়, সরকারের সমালোচনা তিনি সহ্য করবেন না। যারা এটা করছেন তাদের সবাইকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হবে। বাসের অনেকে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক বলেও দাবি করেন তিনি। সে ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত কতদুর গড়িয়েছিলো?

- Advertisement -

ভিডিওর এক পর্যায়ে বাসের আরও কয়েক জন যাত্রীকে ওই নারীর ওপর ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়। পরে বাসের যাত্রাবিরতিতে ‘সরকারের সমালোচনাকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত বাসযাত্রী আরেকটি ফেসবুক লাইভ করেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, ওই ঘটনার রেশ শেষপর্যন্ত পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। পুলিশ বাস থামিয়ে সবার বক্তব্য নিয়েছে এবং ওই নারী ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।

সেই রাতে লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকামুখী বাসে প্রকৃতপক্ষ কী ঘটেছিল, তা অনুসন্ধান করে খোঁজা হয়েছে সেই তরুণীর প্রকৃত নাম পরিচয়। এতে বেরিয়ে এসেছে আলোচিত ওই তরুণীর নাম ফাতেমা তুজ জোহরা রিপা। বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায়। রিপা রামগঞ্জ মডেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

উপজেলা ছাত্রলীগের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক রিপা বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকাতেই থাকেন। গত ২১ জানুয়ারি রাতে রামগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার সময় ঘটে আলোচিত ওই ঘটনা।

এর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হাতে লাঠিসহ রিপার একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীদের হামলায় ডাকসুর সে সময়ের ভিপি নুরুল হক নুরুসহ ২৫ জন আহত হন। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক রিপা অংশ নেন সেই হামলায়।

এছাড়া, ২০১৯ সালের এপ্রিলে রামগঞ্জ উপজেলা শিক্ষক সমিতির একটি অনুষ্ঠানে স্থানীয় এমপির সঙ্গে সভা মঞ্চে ওঠা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নেমে যেতে বলা হয়। রিপা নামতে রাজি না হলেও পরে তাকে বাধ্য করা হয়। এরপর ফেসবুক লাইভ এসে কান্নাকাটি করে ভাইরাল হয়েছিলেন রিপা।

বার বার বিভিন্ন ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দেয়া রিপা কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সঙ্গে। গত ২১ জানুয়ারি বাসে কী ঘটেছিল সে বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন। রিপার দাবি, পুলিশ আসার পর তিনি ক্ষমা চাননি, উল্টো অভিযুক্ত যাত্রী ভুল স্বীকার করেছেন।

বাসে উত্তেজিত হওয়ার কারণ তুলে ধরেন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাস চলার সময় আমার পাশের সিটের যাত্রী ফোনে কথা বলছিলেন। একপর্যায়ে তিনি সরকারকে নিয়ে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। তখন আমার খুব খারাপ লেগেছে, আমি যেহেতু ছাত্রলীগ করি আমার খারাপ লাগবেই।

‘তিনি (পাশের যাত্রী) ফোনটা রাখার পরে আরও বাজে ভাষায় কথা বললেন। শেখ হাসিনা আপাকে নিয়ে আরও নোংরা ভাষায় কথা বলেছে। তখন আমি আমার রাগটা কন্ট্রোল করতে পারিনি। আমি প্রতিবাদ করেছি, ফোনে লাইভ দিয়েছি।’

রিপা বলেন, ‘সরকারের বদনাম যেখানে হয়, সব সময় আমি প্রতিবাদ করি। আমি নতুন প্রতিবাদ করিনি, আগেও করেছি, এখনও করছি, ভবিষ্যতেও করব। সরকারকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার স্বাধীনতা মানুষের আছে কিন্তু কাউকে নিয়ে খুবই নোংরা ভাষায় কথা কেউ বলতে পারে না। সে জন্যই আমি প্রতিবাদটা করেছি।’

পাশের সারির আসনে বসা যাত্রী ফোনে কথা বলার সময় কীভাবে শুনলেন- এমন প্রশ্নে রিপার জবাব, ‘এটা তো পাবলিক প্লেস, এখানে তো ফোনের কথা শোনা যাবেই, পাশের সিট যেহেতু আমি তো শুনবোই।’

ভাইরাল ভিডিওটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করছেন। তবে রিপার দাবি, এতে তার বা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়নি।

কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘একটা বিষয় ভাইরাল হলে সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবেই। আর বিরোধী দল তো সেটা নিয়ে সমালোচনা করবেই। জামায়াত-শিবির-বিএনপি এরা তো সমালোচনা করবেই।

‘আমাদের আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অনেক উন্নয়ন করেছে। কখনও কোনো সরকার এত উন্নয়ন করেনি। এত উন্নয়ন ভোগ করে, এত সুবিধা ভোগ করে সরকারের বদনাম করা বা সরকারকে নিয়ে নোংরা ভাষায় মন্তব্য করা ঠিক না।’

ফেসবুক লাইভে বাসের যাত্রীদের জামায়াত-শিবির-বিএনপির সমর্থক আখ্যায়িত করার কারণ জানতে চাইলে রিপা বলেন, ‘আমি সবাইকে জামায়াত-শিবির বলিনি, যারা আমার সঙ্গে বাসের মধ্যে ঝগড়া করেছিল তাদেরকে বলেছি।’

‘আমার পাশের সিটে যে লোকটা নেত্রীর বদনাম করছিল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কেন সরকারের বদনাম করছেন, নোংরা ভাষায় কেন কথা বলেছেন? এ সময় তার পিছনের সিটে একজন হুজুর ছিলেন, তিনি লাফিয়ে উঠে আমাকে খারাপ ভাষায় গালমন্দ করছিলেন। আমি তাকে বললাম আমি তো আপনার সঙ্গে কথা বলছি না, যিনি সরকারের বদনাম করেছে উনার সঙ্গে কথা বলছি। এতে আপনার সমস্যা কী, কিন্তু উনি খারাপ ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছিলেন পেছন থেকে।’

বাসের আরও কয়েক যাত্রী বিতণ্ডায় যোগ দিয়েছিলেন দাবি করে রিপা বলেন, ‘আরেকটা ছেলে ছিল, সেও আমাকে গালমন্দ করছিল। আমার মনেই হয়েছিল উনারা বিএনপি। উনারাও বলল আমরাও ছাত্রলীগ করতাম এক সময়, আমরাও আওয়ামী লীগ করতাম, আসলে কিন্তু ভুল। কোনো ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ সমর্থক জননেত্রী শেখ হাসিনার বদনাম করতে পারেন না, নোংরা ভাষায় গালি সাপোর্ট করতে পারেন না।’

ভিডিওতে প্রাণ হারানোর শংকা জানানোর কারণ জানতে চাইল রিপা বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল তারা তিন জন পুরুষ। তারা পরবর্তীতে একত্রিত হয়ে আমার ওপর হামলা করবে এবং উনারা বলেছিলেন যে বাসের লাইটটা বন্ধ করে দেন। তখন আমার খারাপ লেগেছিল। আমি একজন নারী, বাসের ভেতরে এত পুরুষের মধ্যে লাইটটা বন্ধ করে দেয়া কী ঠিক হবে!

‘পরবর্তীতে উনারা বাসের হেলপারকে বলেছিলেন উনার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে যান এবং লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে যান। এটাও বলেছিলেন এটাকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে ফেলে দেন এবং উনারা আমাকে ধাক্কা দিতেও এসেছিলেন। উনারা আমার সঙ্গে খুবই নোংরা ভাষায় গালমন্দ করেছিলেন। তখনই আমার মনে হয়েছিল আমার ওপর একটা হামলা হতে পারে।’

নিজের ভূমিকার পক্ষে যুক্তি দিয়ে রিপা বলেন, ‘আপনারা জানেন বিভিন্ন মানুষ. বিশেষ করে শিবির-বিএনপি-জামায়াত এরা সরকারের বদনাম করে। তাদের অভ্যাসই হলো বদনাম করা, তাই আমরা প্রতিবাদ করলে এই বদনামগুলো করতে পারবে না। আমি প্রতিবাদ করেছি, কাল আবার আরেক জন প্রতিবাদ করবেন। এভাবে প্রতিবাদ করলে তারা আর বদনাম করতে পারবে না। আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত।’

লাইভ শেষ করার পরের ঘটনা জানিয়ে রিপা বলেন, ‘যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম তারা আমার হাত থেকে ফোনটা টেনে নিয়ে যাবে এবং আমাকে আক্রমণ করার সম্ভাবনা আছে, তখন লাইভটা কেটে দিয়েছি। এরপর আমি ট্রিপল নাইনে কল করেছি।

‘লাইভটা দেখার পরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সোহেল রানা শান্ত ভাইও ট্রিপল নাইনে কল করেছেন এবং বিভিন্ন স্থানে পুলিশকে ফোন দিয়েছিলেন আমার নিরাপত্তার স্বার্থে।’

৯৯৯-এ কল করার পর লালমাই হাইওয়ে পুলিশ বাসটি থামায় বলে জানান রিপা।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ রাস্তার পাশে তেলের পাম্পে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে ওই যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমাকেও করেছিল। আমি কে বা কোথা থেকে এসেছি- জানতে চেয়েছে। এটা উনারা জানতে চাইতেই পারেন। যারা ছিল সবাইকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এক পর্যায়ে উনারা (বাসের কয়েক যাত্রী) ক্ষমা চেয়েছেন।’

রিপা বলেন, ‘পরে পুলিশ বললো, আপনি ভিডিওটা ডিলিট করে দেন। যেহেতু উনারা ক্ষমা চেয়েছেন, আপনিও ক্ষমা করে দেন। আমি তখন ভাবলাম, ক্ষমা করে দেই, ভুল তো মানুষেরই হয়। উনারা বলেছেন, পরবর্তীতে এই ভুল হবে না, তারা সরকারের বদনাম করবেন না।’

ভাইরাল হতে এমন লাইভের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রিপা বলেন, ‘যারা বলছেন, আমি ভাইরাল হওয়ার জন্য এমন ভিডিও করেছি তারা ভুল বলছেন। আমি ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-শিবির-ছাত্রদল ঠেকানোর জন্য লাঠি হাতে নিয়েছিলাম। তখনও ভাইরাল হয়েছি। তবে আমার ভাইরাল হওয়ার কোনো শখ নেই। আমি প্রতিবাদ করি, প্রতিবাদী মেয়ে। আগেও প্রতিবাদ করতাম।’

২০১৯ সালের ঘটনা নিয়ে রিপা বলেন, ‘ডাকসুতে ভিপি নুরুর সঙ্গে ছাত্রদল-শিবিরের কিছু ছেলে ছিল। উনারা ওখানে ৭৫-এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেক বার বলে স্লোগান দিচ্ছিল। আসলে ৭৫-এর হাতিয়ার বললে আমাদের কষ্ট হয়, আমাদের খারাপ লাগে। আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি, ছাত্রলীগ করি আমাদের খারাপ লাগবেই।

‘এ সময় দুই পক্ষই স্লোগান দিচ্ছিল। উনারা আমাদের উপর প্রথম হামলা করেন। তারাই আগেই লাঠি হাতে নিয়েছিলেন, পরে আমিও লাঠি হাতে নিয়েছিলাম। আমি লাঠি হাতে নিয়েছিলাম ছাত্রদলকে ঠেকাবো বলে। ওখানে আমি একা মেয়ে ছিলাম, তাই নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে আমি লাঠি হাতে নিয়েছিলাম।’

বাসে ভাইরাল ভিডিওর পাশাপাশি ‘আহত রিপার’ একটি ছবি ছড়িয়েছে ফেসবুকে। সেই ছবি দিয়ে অনেকের দাবি, সেদিন বাসে হামলার শিকার হন রিপা।

তবে রিপা জানান ছবিটি কয়েক মাস আগের। তিনি বলেন, ‘এটা ২০২১ সালের অক্টোবরের ২১ তারিখের ছবি। আমি খাগড়াছড়িতে গিয়েছিলাম। তখন এক ছোট ভাইয়ের মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যায়। সেই ঘটনার ছবি দিয়ে এখন গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’

সূত্র : নতুন সময়

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles