: ২৪ অক্টোবর ২০২০ | দেলওয়ার এলাহী |
আমার বাল্যবন্ধুর একটি টিয়া
পাখি ছিল। সবুজ। সুন্দর। প্রাণচঞ্চল। অদ্ভুত চোখে আমাদের দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে
থাকতো। আমার বন্ধুর নাম জামিল। বাড়িতে থাকে সবাই তাকে 'জমিল' নামে
ডাকতেন। চাচা ও খালাম্মা ডাক দিতেন -'ও জমিল'
বলে। পাখিটিও সেই ডাকটি মুখস্থ
করেছিল৷ নতুন কেউ বাড়িতে এলেই পাখিটি ডাক দিতো - ও জমিল!
বিয়ানীবাজারের প্রায় সবার
বাড়িতেই আনারসের ফলন হতো। এমনিতেই কারো বাড়ির আশেপাশে লাগিয়ে রাখলে আনারস বেড়ে
উঠতো। জমিলের টিয়া পাখির প্রধান খাদ্য ছিল আনারসের পাতার কচি অংশটুকু। একটি
বৃত্তাকার লোহার রডের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে সংযোগ করা কাটের একটি কাটিই ছিল সেই টিয়া
পাখিটির ঘর। পায়ে ছোট্ট একটা চেইন লাগানো। সেই চেইনটিতে টিয়া পাখিটি সুন্দর করে
সুর তুলতে পারতো। পছন্দমতো শব্দ রপ্ত করেছিল। ভোরের দিকে যখন পাখিরা জেগে উঠে গান
শুরু করে গাছের ডালে ডালে, আমার বন্ধুর পাখিটিও জেগে উঠতো। সে চাইতো আমরাও যেন ঘুম
থেকে জেগে উঠি। সেই কারণে ভোরের ডাক দেওয়ার মতো নিখুঁতভাবে ঘড়ির মতো এলার্ম বাজাতো
পায়ের চেইন দিয়ে৷
একদিন এক কাঠবিড়াল সেই
পাখিটিকে মেরে ফেললো! আমি আর জামিল দু'জনেই দু'জনের চোখের
আড়ালে কেঁদেছিলাম।
টরন্টোয় আমার এক প্রিয় বন্ধুর
একটি পাখি আছে। অদ্ভুত সুন্দর৷ বাসায় সারাক্ষণ উড়ে বেড়ায়। আমার বন্ধুটির কাঁধে এসে
বসে। দু'জনেই সুখদুঃখ বিনিময় করে। আবার দু'জন ব্যস্ত হয়ে পড়েন জীবনের
নানান টানাপোড়েনে। একদিন বাইরে বেড়িয়ে পাখিটি চোখের আড়ালে চলে গেলো। আমার বন্ধুর
খুব মন খারাপ হলো। কী হলো পাখিটির! অপঘাতে কি তাহলে পাখিটির মৃত্যু হলো। এগুলো
ভাবতে ভাবতে বন্ধুটি অস্থির হয়ে পড়লো। দুইদিন পর সহসা পাখিটি বাড়িতে এসে হাজির!
উইণ্ডসরের রনি রায়ের বাড়িতে
গিয়ে প্রথমেই দুটি অপূর্ব সুন্দর পাখি দেখে আমি অনেক কথাই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম আমার
দুই প্রিয় বন্ধুর পাখির কথাও। কাঁধে এসে চড়ে বসা আমার বন্ধুর পাখির ছবিটিও চোখের
সামনে ভাসছিল। ছেলেবেলায় এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে জাগানো আমার বাল্যবন্ধুর সেই
টিয়াপাখিটির কথাও মনে পড়ছিল।
উইন্ডসরের রনি রায়ের বাড়িতে
দেখেছিলাম অপূর্ব সুন্দর দুটি পাখি৷ ছোট্ট দুটি প্রাণ। অথচ, কী
সুন্দর তাদের রঙ। মনোহর। মায়াবী। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না! নিশ্চয়ই কত প্রেম তাদের
বুকের গভীরে আলোড়ন সৃষ্টি করে৷ পাশাপাশি দুটি প্রাণের বসবাস সত্ত্বেও তাদের জীবনেও
কি আরেকটি পাখির স্বপ্নচারী অস্তিত্ব খেলা করে! তারাও কি স্বপ্নের ডানায় ভর করে
আকাশের ওপারে আরেক আকাশে উড়ে বেড়ায়! তাদেরও কি নিজস্ব ভৈরবী রাগের প্রাণ উতাল করা
কোন সুর আছে!
রনি রায়ের নীলাভ রঙের সেই মায়াবী
পাখিটি নীল আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্তলোকের আকাশে যাত্রা করেছে। কোটি কোটি বছর
আগে প্রাণের উৎস যেখান থেকে শুরু, সেখান থেকে জীবনের উৎসবে এসেছিল পাখিটি। এসে মিশেছিল
আরেকটি হলুদ পাখির সাথে। একসাথে থেকেছিল। সুখদুঃখময় কিছুটা সময় কাটিয়ে নীলাভ
পাখিটি হলুদ পাখিটিকে একা ফেলে আবার জীবনের উৎসের কাছে ফিরে গিয়েছে। নাকি
মহাজীবনের অনন্তযাত্রায় উড়াল দিয়েছে! কে জানে!
একাকী ফেলে রেখে যাওয়া হলুদ
পাখিটির জন্য বড় মায়া হয়!