-0.3 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর: মিয়ানমারকে কী বার্তা দিচ্ছে?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর: মিয়ানমারকে কী বার্তা দিচ্ছে?

৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানায় ভারত সরকার। প্রধানমন্ত্রী চার দিনের সফরে ভারতে গিয়েছিলেন। তার সফরের সময়, তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এবং সেইসাথে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সাথে আলাপচারিতা করেন। সফরের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত কুশিয়ারা নদী থেকে পানি প্রত্যাহার, মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহযোগিতা, রেলওয়ে দ্বারা ব্যবহৃত আইটি সিস্টেমে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। পণ্য পরিবহন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতা, ভারতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ,বাংলাদেশি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ,প্রসার ভারতী এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের মধ্যে সম্প্রচারে সহযোগিতা। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই নেতা কানেক্টিভিটি, বাণিজ্য, রোহিঙ্গা ইস্যু, ফ্রি ট্রানজিট, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, বন্যা ব্যবস্থাপনা, সন্ত্রাস দমন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পারমাণবিক শক্তি অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।

- Advertisement -

জটিল রাখাইন পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা ইস্যু
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য আরও জটিল হয়ে উঠেছে, এবং যেটিকে রোহিঙ্গারা তাদের বাড়ি বলে মনে করে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক অশান্তির বিষয়ে, ভারত স্পষ্ট করে বলেছে যে ভারত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপর নজর রাখছে এবং বাংলাদেশ আশংকা করছে যে এটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রাও জোর দিয়েছিলেন যে “ভারত সরকার বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ, স্থিতিশীল এবং দ্রুত প্রত্যাবর্তনকে সমর্থন করে। এই ক্ষেত্রে, ভারত সবসময় একটি গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে এবং একটি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে”। তিনি আরও আশ্বাস দিয়েছেন যে রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে এবং ভারত তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে সব ধরনের সহায়তা দেবে।

গত দুই মাস ধরে, রাখাইন বৌদ্ধদের একটি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি ও মায়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় উঠেপরে লেগেছে বলে জানা যায়। ২০২০ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং সংঘাত বাংলাদেশের দিকে ছড়িয়ে পড়ায় ঢাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।রিপোর্ট অনুযায়ী, আরাকান আর্মি রাখাইন বৌদ্ধদের স্ব-নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে, যারা নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার বৌদ্ধদের থেকে জাতিগতভাবে আলাদা বলে মনে করে। এখন তারা রাজ্যের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিমান হামলা, কামান ও মর্টার গোলা দিয়ে জবাব দিচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত দু’টি বাংলাদেশে পতিত হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় এক সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সীমান্ত এলাকায় মর্টার শেলিং, নির্বিচারে বিমান থেকে গুলি এবং আকাশপথ লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের বাসিন্দাদের কোনো অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্যও রাষ্ট্রদূতকে আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়েছিল যে এই ধরনের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণের নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্ত চুক্তির লঙ্ঘন ও ভাল প্রতিবেশী সম্পর্কের অন্তরায়।

এক কথায় বলতে গেলে, রাখাইন রাজ্যের সংঘাত যেকোনো প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে, বিশেষ করে যেহেতু রোহিঙ্গারা পূর্বে বসবাস করত এমন অনেক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এএ-এর হাতে রয়েছে বলে জানা যায়। নতুন এই সংঘাত সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকারী বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনেও উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। ভারত তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের জান্তার উপর প্রভাব খাটাতে পারে। মায়ানমারে অভ্যুত্থানের আগেও”বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির” হিসাবে পরিচিত কক্সবাজারে বসবাসকারী শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ঢাকা নেপিডার সাথে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল।

উল্লেখযোগ্যভাবে, ভারত সফরের প্রাক্কালে এএনআই-এর সাথে আলাপচারিতায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুকে বাংলাদেশের জন্য একটি ‘বড় বোঝা’ বলে অভিহিত করে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানে ভারতের সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভারত মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের তাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি করাতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে এবং যেটিকে রোহিঙ্গারা তাদের আবাস বলে মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইস্যুটি আরও জটিল হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা
৬ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত সাতটি চুক্তির মধ্যে, বাংলাদেশের পক্ষ হতে কুশিয়ারা থেকে ১৫৩ কিউসেক (কিউবিক ফুট প্রতি সেকেন্ড) পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে, যেটিকে সবচেয়ে বেশি স্বাগত জানিয়েছে ঢাকা। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর জল-বণ্টন চুক্তির পর এই ধরনের প্রথম চুক্তিতে দুটি দেশ স্বাক্ষর করেছে এবং সমস্যা সমাধানে অগ্রগতি হিসাবে দেখা হচ্ছে যা দেশ দুইটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ । চুক্তিটি মাধ্যমে ভারতের আসাম রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল উপকৃত হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি সংযোগ, বাণিজ্য, বন্যা ব্যবস্থাপনা, সন্ত্রাস দমন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পারমাণবিক শক্তির অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো এবং বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জ্বালানি মূল্যের কারণে দেশটি যে জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে তা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে, দুই নেতা ১৩২০ মেগাওয়াট সুপারক্রিটিকাল কয়লাভিত্তিক মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উদ্ভোদন করেন, যেটি বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নামে পরিচিত । বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে প্রকল্পটি বাংলাদেশের নাগরিকদের সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুতের নিশ্চয়তা দেবে ও বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়াবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছিল এ সফরে। ৫.১৩ কিমি রূপসা রেল সেতুটি ৬৪.৭ কিলোমিটার খুলনা-মংলা বন্দর একক-ট্র্যাক ব্রডগেজ রেল প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা প্রথমবারের মতো মংলা বন্দরকে (বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর) খুলনার সাথে রেলপথে সংযুক্ত করে এবং তারপরে ভারত সীমান্ত দিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোল এবং গেদেতে পৌছায়। সংযোগ উদ্যোগগুলি বাংলাদেশে চলমান প্রকল্পগুলির অংশ যা দেশটিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি প্রধান সংযোগ কেন্দ্রে রূপান্তর করবে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে সংযোগের সম্প্রসারণ এবং সীমান্তে বাণিজ্য অবকাঠামোর উন্নয়নের সাথে, দুই অর্থনীতি একে অপরের সাথে আরও সম্পর্ক করতে সক্ষম হবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ব্যবধানকে সংকুচিত করতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত করতে উভয় পক্ষ এই বছর একটি অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (CEPA) নিয়ে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে। এটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে (CEPA) কার্যকর হলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্ভাবনা ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে।

পরিশেষে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও সংযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, নদী এবং সামুদ্রিক বিষয়াদি সহ সকল ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব প্রসারিত হয়েছে তা বলা যেতেই পারে। সমস্ত দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ও সহযোগিতার জন্য এটি প্রভাবক হিসাবে কাজ করবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের টেকসই, নিরাপদ এবং অনুকূ প্রত্যাবাসনে ভারত বিশ্বব্যাপী তার কূটনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগাবে বলেই বিশ্বাস।

কামাল উদ্দিন মজুমদার 
গবেষক ও কলামিস্ট
- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles