8.8 C
Toronto
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

আমার ছোটবেলা : পর্ব ১

আমার ছোটবেলা : পর্ব ১
আমার কিশোর বেলার ছবি

আজকাল একা যখন বসে থাকি কতো পুরানো কথা যে মনে এসে ভিড় করে। যে কথা গুলো মনে পরার কোন কারণই নেই তবুও মনে পরে । ৪০ বছর হয়ে গেলো , যে সব কথা এত বছর মনে হয়নি এখন কেনো মনে পরে যাচ্ছে নিজেই নিজের জন্য মুগ্ধ হচ্ছি। হঠাৎ করে কি ভাবে আমার স্মরণ শক্তি এত প্রখর হয়ে গেলো ভেবে বিস্মিত না হয়ে পারছি না। নিজের জন্য নিজে একটা হাত তালি দিলাম এখন। চুপি চুপি কাউকে না জানিয়ে নিজেকে বাহাবা দেয়া নিজের ভালো কাজের জন্য নিজেকে হাত তালি দেবার আনন্দই আলাদা । এতে কোরে নিজের সাথে নিজের নতুন করে পরিচয় ঘটে । মানুষ নিজেকে নিজে ভালবাসতে শিখে। যে নিজেকে ভালবাসতে জানে না সে পৃথিবীকেও ভালবাসতে পারে না ।

এখন একটু আমার জন্মস্থান এবং বেড়ে উঠা কুমিল্লা শহরের একটু স্মৃতি চারন করি , যেটা আমার স্মৃতির জালে এখন ধরা পড়েছে ।

- Advertisement -

আমাদের কুমিল্লার মানুষদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষের নামগুলোকে একটু অন্যভাবে ডাকা। যেমন- কামাল কে কামাঈল্লা, ফারককে ফারুইক্কা, ফুলীকে ফুলুনী, তিথিকে তিথুনী, লোটাসকে লোটাসচ্চা। এই ডাক গুলো কখনো ছিলো ভালোবেসে কখনো ছিলো তাচ্ছিল্য ভরে ।

ফজু নামটা শুনলে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হয় তার প্রকৃত নাম ফোজলূ কিংবা ফজল হবে ।কিন্তু যেহেতু সে নারী ছিলো তাকে ডাকা হতো ফোজুনী এবং ফজু পাগলী। ফজু বছরের তিন চার মাস পাগল থাকতো আর বাকী সময়টা থাকতো সুস্থ স্বাভাবিক । ফজুর সাথে আমাদের ছোট বেলার অনেক স্মৃতি । ফজূ কোথা থেকে এলো, কি ভাবে এলো, তার আদি বাস কোথায় আমরা কিছুই জানতাম না । ফজু এখন পাগল হয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারতাম ওর পোষাক পরিবর্তন দেখে। তখন ফজু নারী থেকে পুরুষের পোষাক পরতে শুরু করতো। শাড়ি ব্লাউজ ছেড়ে লুঙ্গি সার্ট স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ছুটাছুটি করতো । এক হাতে থাকতো একটা লাঠি আর আরেক হাতে ঘাস কাটার কাস্তে । প্রচণ্ড রোদে বসে বাগানের পরিচরচা করতো, ছিপ ফেলে মাছ ধরতো । মাঝে মাঝে জাল ফেলতো মাছ ধরার জন্য। ফজুর কাছে আমি ছিপ ফেলে মাছ ধরা শিখেছিলাম। পাগল অবস্থাতে ফজুর প্রধান কাজ ছিলো পুরুষদের গুষ্টি উদ্ধার করা। কিছুক্ষণ পর পরই হৈহৈ করে চিৎকার দিয়ে বলতো-

“আয় ব্যডারা তোরার গলা কাইটটা পুশকুনির পানিতে ছুবাইয়া থুমু। কুত্তার জাত, খাওন দেখলে দৌড় মারছ। মাইয়া মানুষ দেখলে জিব্বা দিয়া পানি পরে। আয় তোরার জিব্বা কাইটা কুছি কুছি কইরা ভাইজা খামু”। আরো অনেক কুৎসিত ভাষা ফজু ব্যবহার করতো ফজু পুরুষ জাতির বিরুদ্ধে । শালীনতার খাতিরে সে গুলো উল্লেখ করলাম না। সব চাইতে ভালো ব্যপার যেটা ছিলো তার পাগলামিটা তার নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো ও অন্য কারো কোন ক্ষতি করতো না। ফজু খুব বিবেচক পাগল ছিলো। ও এক বাড়ীতে বেশী দিন থাকতো না। ওর নির্দিষ্ট চারটা বাড়ি ছিলো। ঘুরে ঘুরে সব বাড়ীতে ফজু থাকতো । ফজুর পাগলামি শেষ হয়ে যাচ্ছে আমরা বুঝতে পারতাম যখন ফজু আবার নারী বেশ ধারন করতো ।

আমি এখন ভেবে অবাক হই আমাদের মায়েদের উদারতা দেখে। ফজু এসে থাকতো খেতো, ঘুমাতো কিন্তু আম্মা কখনো ফজুকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দে্ননি। ফজু নিজ দায়িত্বে বাড়ি পাহাড়া দিতো। ফুলের বাগান ফলের বাগানের কাজকর্ম করতো । আম্মা মাঝে মাঝে টুকটাক বাজার করার জন্যও ফজুকে পাঠাতো আমরাও পাঠাতাম। যখন ও পাগল থাকতো না তখন। ফজু নিষ্ঠার সাথে সব পুরুষালী কাজগুলো করতো।

ফজু যখন পাগল থাকতো না তখন ফজুকে ঘিরে বসে ফজুর সাথে গল্প করতে বসতাম । আমাদের প্রতি ওর অনেক মায়া ছিলো । ফজুকে আমরা জিজ্ঞেস করতাম -ফজু তুমি কেনো পাগল হও? ফজুর জবাব ছিলো –

”জানি না ছোটবেলায় জ্বিনে ধরছিল, হেই জ্বিনডা যখন আইয়ে তখন পাগল হই জ্বিন গেলে গা আবার ভালা হইয়া যাই” । ফজু অনেক গল্প আমাদের শুনাতো ওর জীবন নিয়ে আমরা গালে হাত দিয়ে ওর গল্প শুনতাম। গল্পগুলো ছিলো এরকম—ছোটবেলাতে কোন এক সন্ধ্যাতে গাছের নীচ দিয়ে যাবার সময় ওকে জ্বিনে ধরে। তারপর থেকে ও পাগল হয়ে যায় । ফজুর একটা বিয়ে হয়েছিলো । যখন ফজুর পাগলামি শুরু হতো তখন ওর স্বামী আর শাশুড়ি মেরে ওকে অজ্ঞান করে ফেলতো । খেতে দিতো না। মৌলবি ডাকা হতো ওর পাগলামি ছাড়াবার জন্য। মৌলবি বলতেন পাগলামি ছাড়াতে হলে ফজুকে তার বাড়ীতে রাখতে হবে কিছুদিন। ফজুকে মৌলবীর বাড়ীতে থাকতে হতো কিছুদিন। আর সে মৌলবী শালা প্রতিদিন ওর সাথে খারাপ কাজ করতো । তখন খারাপ কাজটা আমরা বুঝতে পারতাম না। আমাদের চোখ ছল ছল হয়ে যেতো। আমি জিজ্ঞাস করতাম মৌলবী লোকটাও তোমাকে মারতো? ফজু আমার কথার কোন জবাব দিতো না। ফজুর নাকি একটা কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহন করেছিলো। দুই মাসের মাথায় শিশুটি মারা যায় । তারপর ফজুর স্বামী ফজুকে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ফজু আবার ফিরে যায় মা ভাইদের কাছে ফজু যখন পাগল হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বন বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতো তখন অনেক পুরুষই তাকে একা পেয়ে শারীরিক নির্যাতন করেছে। ফজুর ভাইরা ফজুকে ধরে এনে অমানুষিক ভাবে মারতো । একবার মেরে ওর হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলো। এসব দেখে ফজুর মা কপাল চাপড়ে কাদতো ।

মাঝে মাঝে ফজু গায়েব হয়ে যেতো। বেশ কিছুদিন পরে আবার ফিরে আসতো । আম্মা জিজ্ঞাস করতেন, “ ফজু কই ছিলি এতদিন”? ফজু জবাব দিত বাড়িত গেছিলাম বেরাইম্মা মাডারে দেখতে। বুড়ি আর বেশি দিন বাঁচতো না।

ফজুকে নিয়ে অনেক গল্প করে ফেললাম। আরো বহু গল্প ফজু আমাদের সাথে করতো সেটা যদি বলতে বসি তাহলে আমার লেখার নাম ‘ আমার ছোটবেলা’ বদলে দিতে হবে “ ফজু নামা”। তাই আজকের মতো ফজুকে বিদায় দিলাম।

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles