14 C
Toronto
সোমবার, মে ৫, ২০২৫

আয়নাঘরে আটকে রেখে কিডনি কেটে নেওয়া হতো!

আয়নাঘরে আটকে রেখে কিডনি কেটে নেওয়া হতো! - the Bengali Times
ছবি সংগৃহীত

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে একটি বাড়ির ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছিল মিনি ‘আয়নাঘর’। সেখানে মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতন, চাঁদাবাজি, জমি লিখে নেওয়া ও কিডনি বিক্রির মতো অভিযোগে এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে চাঞ্চল্য।

শুক্রবার (২ মে) ভোরে রায়গঞ্জ উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সোনারাম গ্রামে ঘরটির সন্ধান মেলে। পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা এবং সংবাদকর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে এর ভেতরে একাধিক ছোট কক্ষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই ঘরটিতে কাউকে কখনো যাতায়াত করতে দেখা যায়নি।

- Advertisement -

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ওই ঘর থেকে পালিয়ে বের হন দুইজন। যাদের একজন হলেন পূর্ব পাইকড়া গ্রামের মৃত রুস্তম আলীর ছেলে আব্দুল জব্বার (৭৫) এবং অন্যজন লক্ষ্মী বিষ্ণু প্রসাদ গ্রামের মুনসুর আলীর স্ত্রী শিল্পী খাতুন (৪৮)। তারা ধারালো কাঁচি দিয়ে টানা কয়েকদিন মেঝে খুঁড়ে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করে পালিয়ে আসেন। পরে পরিবারের সদস্যদের কাছে সব খুলে বললে ঘটনাটি জানাজানি হয়।

স্থানীয়রা জানান, উপজেলার পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামের রেজাউল করিম তালুকদারের ছেলে আরাফাত গ্রাম্য ডাক্তার হলেও তার কোনো সার্টিফিকেট নেই। তিনি দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। এলাকায় তিনি সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেন। তিনি কখনো সাংবাদিক, কখনো সমন্বয়কের পরিচয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াতেন। তার বিরুদ্ধে মামলাবাজি, চুরি, ব্ল্যাকমেইলসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও আয়নাঘরে মানুষ আটকে রাখার বিষয়টি জানা ছিল না। আয়নাঘর থেকে দুজন মানুষ বের হওয়ার খবরে মানুষ হতভম্ব।

স্থানীয় জুয়েল রানা জানান, আরাফাত মানুষকে অপহরণ করে গোপন স্থানে আটকে রাখতেন। তার নেতৃত্বাধীন চক্র আয়নাঘরে মানুষজনকে আটকে রেখে কিডনি কেটে নিয়ে পাচার করত। তার বড়ভাই নাঈম আহমেদ বাঁধন ঢাকার সাভারে এনাম মেডিকেলের চিকিৎসক। ভাইকে তিনি কিডনি সরবরাহ করতেন।

শুক্রবার ভোরে উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত সোনারাম গ্রামে দিনমজুর জহুরুল ইসলামের বাড়িতে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে আয়নাঘর থেকে সুরঙ্গ পথ তৈরি করে শিল্পী খাতুন (৩৮) ও আব্দুল জুব্বার (৭৫) বেরিয়ে আসেন। কবর আকৃতির প্রতিটি কক্ষ মাত্র চার ফুট উঁচু, নয় ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ চার ফুট। ওই ঘরে শিল্পী ও জুব্বার বন্দি ছিলেন। ভুক্তভোগী শিল্পী চান্দাইকোনা ইউনিয়নের লক্ষ্মীবিষ্ণু প্রসাদ গ্রামের মুনসুর আলীর স্ত্রী। আর জুব্বার একই ইউনিয়নের পূর্ব পাইকড়া গ্রামের বাসিন্দা। নির্মাণাধীন ভবনের নিচে আয়নাঘরের প্রতিটি কক্ষ একেকটি কবরের সমান। সামনে করিডোর, ছোট ছোট দরজা। ঘরের পূর্ব কোণায় সুরঙ্গ রয়েছে। এ সুরঙ্গ দিয়ে দুইজন পালিয়েছেন। আয়নাঘরটি বিক্ষুব্ধ জনতা ভেঙে ফেলেছে। চান্দাইকোনা ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বর জহুরুল ইসলাম বলেন, সোনারাম গ্রামের জহুরুল একজন কুলি। হঠাৎ করে তার বাড়িতে ভবন নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সবার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। আরাফাতের টাকায় ভবনটি নির্মাণ হচ্ছে বলে গ্রামবাসীর ধারণা। তিনি আরও বলেন, মাটির নিচে যেভাবে ছোট ছোট কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায়-সেটি একটি টর্চার সেল। সম্ভবত মানুষ ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করা হতো।

এছাড়া সোনারাম গ্রাম থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামে আরাফাতের বাড়িতে ইরি ধানের প্রজেক্টে আরেকটি আয়নাঘরের সন্ধান পাওয়া যায়। এ আয়নাঘরের তিনটি কক্ষ। শব্দ যাতে বাইরে আসতে না পারে সেজন্য দুই স্তরের দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী শিল্পী খাতুন বলেন, পাঁচ মাস আগে রাস্তা থেকে আমাকে মাইক্রোবাসে তুলে মুখে টেপ ও হাত বেঁধে ফেলে কয়েকজন। এক মাস অন্য একটি জায়গায় বন্দি রেখেছিল। পরে ওই ভবনের নিচ তলার ছোট একটি কক্ষে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। আমার কিডনি নেওয়ার হুমকি দিত তারা। আমার এক মাসে আগে বৃদ্ধ জুব্বারকে সেখানে আনা হয়। তার কাছ থেকেও জমি ও কিডনি নিতে চেয়েছিল তারা।

তিনি আরও জানান, জুব্বারের পায়ে একটি ক্ষত ছিল, সেই ক্ষত ড্রেসিং করার জন্য ভেতরে একটি কাঁচি রেখে যায় আরাফাত। সেই কাঁচি দিয়ে ৪-৫দিন ধরে সুরঙ্গ তৈরি করে বের হন তারা।

আব্দুল জুব্বার বলেন, আরাফাত কৌশলে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে ওই আয়নাঘরে নিয়ে বন্দি করেছিল। কেন বন্দি করেছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার জমির খতিয়ান নম্বর ও দলিল কোথায় রেখেছি সেটা জানতে চেয়েছিল। আমি বলিনি। এজন্য শিকলে তার হাত-পা বেঁধে রেখেছিল। টানা ২-৩দিন খাবার দেওয়া হতো না। ডান পায়ের ঊরুতে ইনজেকশন দিয়ে মাঝে-মধ্যে আঘাত করত আমাকে। গোপন ঘরে তাদের দিনে একবার খেতে দেওয়া হতো। গোসলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

পুলিশ জানায়, ঘটনাটি বেশ রহস্যজনক। বৃদ্ধ ও নারী সেখানে ৫-৬ মাস কীভাবে ছিলেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভবনটি দেখেও ছয় মাসের পুরোনো মনে হয় না। আবার কথিত আয়নাঘরটি তৈরি হয়েছে সেটিও সঠিক। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

রায়গঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান জানান, একজন নারী ও একজন পুরুষকে (বৃদ্ধ) আটকে রাখার অভিযোগে গ্রাম্য চিকিৎসক নাজমুল ইসলাম আরাফাতসহ ২৫ জনকে আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে। শিল্পী খাতুনকে বন্দি রাখার অভিযোগে তার স্বামী মনছুর রহমান বাদী হয়ে এবং জুব্বারকে বন্দি রাখার অভিযোগে তার ছেলে শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। দুটি মামলাতেই আরাফাতকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।

শনিবার গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আয়নাঘরের ব্যাপারে তদন্ত চলছে।

এ বিষয়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি ইকরামুল হোসাইন বলেন, অন্য আসামিরা গ্রেফতার হলে কথিত আয়নাঘরের প্রকৃত রহস্য জানা যাবে। তবে, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে-বিভিন্ন লোককে তারা বন্দি করে টাকা আদায় করত।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles