
সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষের কানাডায় আসা নিয়ে কমিউনিটিতে নানান গুঞ্জন , পক্ষ বিপক্ষ মতামত রয়েছে। তবে ঢালাও অভিবাসন এর বিষয়টা যে একেবারে কাকতালীয় , তা নয়। সরকারের উপরে যে সরকার , তাদের পলিসি জানতে পারলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং এর পেছনের কারণ অনুধাবন করা অনেক সহজ হয়ে যায়।
যারা পলিসি মেকারদের খোঁজ খবর রাখেন, তারা শুনে থাকবেন , সেঞ্চুরি ইনিশিয়েটিভ নামে একটা এডভোকেসি গ্রুপ আছে, যারা ঢালাও অভিবাসন এর পক্ষে ওকালতি করে থাকে । একটা রিপোর্টে দেখতে পেলাম , কানাডার বড়ো ব্যাংকগুলো সেই গ্রুপকে পয়সা যোগাচ্ছে। এই গ্রুপটির উদ্দেশ্য , আগামী ২১০০ সালের মধ্যে কানাডার জনসংখ্যা আরো ৬০ মিলিয়ন বা ছয় কোটি বাড়িয়ে দিতে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্যাংকগুলো এই গ্রুপকে সমর্থনের উদ্দেশ্য কি। সোজা উত্তর, এই যে আবাসন নিয়ে উদ্ভূত মূল্যস্ফীতি , বাড়ির দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি , এটি তাদের জন্য বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত মুনাফা যোগান দেয়।
গণ অভিবাসন এর যে নীতি গত চল্লিশ বছর ধরে নেয়া হয়েছে , তাতে কানাডার জনসংখ্যায় যোগ হয়েছে ১২ মিলিয়ন মানুষ আর সেই সাথে ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন নতুন ঘরবাড়ির নির্মাণ। এর সূত্র ধরে এসেছে কয়েক মিলিয়ন নতুন মর্টগেজ। আর গত দশকে যে হারে দাম বেড়েছে , তাতে আনুপাতিক হারে মর্টগেজগুলো ও অনেক বেশি বেড়ে যায়। বাড়তি জনগণের চাপ বা চাহিদা না থাকলে সেটা হতো না।
তাই ব্যাপারটা উইন উইন যদি আপনি ব্যাঙ্ক , বা ডেভেলপার বা মধ্যস্বত্বভোগী হন । আর বাকি আমরা যারা আছি , তাদের জন্য ততটা নয়। এই যে পরগাছাগুলো সিস্টেম থেকে অতিরিক্ত টাকা বের করে নিচ্ছে, সেটির মূল যোগান আসে তো কানাডিয়ানদের পকেট থেকে , কেননা আবাসন খাতে যে মূল্যস্ফীতি , তাতে তো অর্থনীতিতে প্রকৃত কোনো মূল্য সংযোজন হচ্ছে না।
ব্যাংকগুলোকে এমন ধরণের নীতি সমর্থন করতে দেয়া বা অগ্রসর করতে দেয়া হচ্ছে , যে নীতি কানাডিয়ানদের ঠকিয়ে তাদের নিজেদের অতিরিক্ত মুনাফা করতে দেয়। রিয়েল এস্টেট এর খরচ বাড়তে থাকলে অন্য সব উৎপাদনশীল খাতের খরচ ও বেড়ে যায়। তা ছাড়া কে না জানে , বাড়ি কেনা বা বাড়ি ভাড়ার খরচ বাড়লে সংসারের অন্য প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে ঘাটতি দেখা দেয় আর তাতে জীবনযাত্রার মান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে উপায় নেই ।
আরো অভিযোগ আছে , এই ঢালাও অভিবাসনের আরেকটা উদ্দেশ্য , বাজারে সস্তা অনুগত শ্রমের যোগান দেয়া। এখনকার বেকারত্বের পরিস্থিতি দেখলে এই অভিযোগ অস্বীকারের খুব একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি একটি ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছে। টরোন্টোর এয়ারপোর্টে একটা কোম্পানি ন্যুনতম মজুরির চাকুরীর বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো। চাকুরী প্রার্থীদের লাইন কয়েক ব্লক ছাড়িয়ে যায়।
ব্যাঙ্ক , ডেভেলপার , সস্তা শ্রমকারবারি , মধ্যস্বত্ব ভোগীরা ইচ্ছাকৃতভাবেই অভিবাসন নীতিকে প্রভাবিত করে আসছে , কিন্তু এটি টিকে থাকতো না যদি কানাডার প্রৌঢ় জনগোষ্ঠী বা বুমার প্রজন্ম মেনে না নিতো। চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের এই প্রজন্ম তাদের বাড়িঘর এর লেনদেন থেকে অবাধ মুনাফার লোভে টু শব্দটি করে নি। তাদের কনজিউমার মানসিকতা তাদের বুঝতে দেয় নি , এই একচেটিয়া মুনাফার প্রধান বলি কিন্তু পরের প্রজন্ম বা তাদের উত্তরসূরি ছেলেমেয়ে , ক্রেতা হিসেবে যাদেরকে পকেট খালি করেই এই মুনাফা জোগাতে বাধ্য হতে হচ্ছে ।
তাহলে এই মূল্যস্ফীতি কেলেঙ্কারি কি আইনের চোখে অবৈধ , তা হয়তো বলা যাবে না , অন্তত কানাডায় , যেখানে অনিয়ম সব জায়গাতেই বাসা বেঁধে আছে এখনো।
তবে ঢালাও অভিবাসনের বিরুদ্ধে মানুষের সম্বিৎ ফিরতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক জনমত জরিপে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সেই গল্প না হয় আরেকদিন।
টরন্টো, কানাডা