
রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় সোমবার সকালে একটি বাসাবাড়ির সিঁড়ি নিচ থেকে হুমায়ুন কবির (৪৫) নামে এক পুলিশ কনস্টেবলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশের তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হুমায়ুন মূলত স্ত্রীর পরকীয়ার বলি হয়েছেন। তার স্ত্রীর সঙ্গে এক যুবকের পরকীয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেই প্রেম বন্ধ করার জন্য হুমায়ুন নানা সময়ে তার স্ত্রীকে শাসিয়েছেন। আর এই বিষয়টি তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে স্ত্রী সালমা আকতার এবং পরকীয়া প্রেমিক মিলে তাকে হত্যা করেন।
তদন্তে উঠে এসেছে, হত্যার আগে রাতে খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে হুমায়ুনকে দেওয়া হয়। পরে গলায় রশি পেঁচিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন হত্যাকারী প্রেমিক ও সালমা। শেষে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে তারা মরদেহ বাসার নিচে সিঁড়ি দিয়ে নামান। সিঁড়ির পাশে থাকা চলাচলের পথে ফেলে রাখেন। সকালে খবর পেয়ে পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে।
পুলিশ কনস্টেবল হুমায়ুন কবিরের মরদহ উদ্ধারের পর থেকে রহস্য দানা বাঁধতে থাকে। কারণ শুরু থেকেও সন্দেহজনক কথা বলছিলেন তার স্ত্রী সালমা। ফলে তাকে সন্দেহ হয় পুলিশের। যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ এবং তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
আলোচিত এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মাথায় পরকীয়া প্রেমে আসক্ত হুমায়ুনের স্ত্রী সালমা এবং প্রতিবেশী মরিয়ম নামে এক নারীকে গ্রেফতার করেছে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। তবে এখনো সেই প্রেমিককে খুঁজে পাননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
পরকীয়া প্রেমে বাধা কাল হয় হুমায়ুন কবিরের!
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ ঘটনার শুরু থেকে সন্দেহ ছিল সালমার প্রতি। কেননা সালমার আচরণ ছিল সন্দেহজনক। তাকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। অপকটে হত্যার ঘটনা বলতে থাকেন সালমা। কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়, কীভাবে পরিকল্পনা এবং কারা এই হত্যায় জড়িত সব কিছু।
এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত সালমা এবং মরিয়ম জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, সালমার সঙ্গে সেই প্রেমিকের এক থেকে দেড় বছর ধরে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক চলছিল। সেই প্রেমিক সালমার নিকটাত্মীয়। প্রথম দিকে তারা মোবাইল ফোনে এমনি কথা বলতেন। কিন্তু পরে প্রেমিকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন সালমা। পরকীয়ায় আসক্ত হওয়ার পর সালমা সবসময় সেই ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন। বিষয়টি নানা সময়ে হুমায়ুনের চোখেও ধরা পড়ে। তিনি জানতে পেরে পরকীয়ায় আসক্ত স্ত্রীকে নানাভাবে তাকে শাসিয়েছেন। দুই পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিচার বসিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। সর্বশেষ যে ফোন দিয়ে সালমা পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলতেন সেটি ভেঙে ফেলারও ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কিছুতেই সমাধান হয়নি।
অন্যদিকে হুমায়ুনের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন সালমা। কেন তার নামে আত্মীয়-স্বজনের কাছে বিচার দিয়ে তাকে অপমানিত করা হলো! এই ক্ষোভ থেকে স্ত্রী সালমা সেই ভবনের একটি ফ্লাটে থাকা মরিয়ম এবং তার প্রেমিককে নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
হত্যার পরিকল্পনা হয় শনিবার রাতে:
হুমায়ুনের স্ত্রী সালমা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, সর্বশেষ হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয় শনিবার রাতে। এ হত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পরকীয়া প্রেমিক এবং তার প্রতিবেশী মরিয়মও সঙ্গে ছিলেন। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা রোববার দিনের কোনো এক সময়ে বাসার নিচের ফার্মেসি থেকে ঘুমের ওষুধ কিনে নিয়ে আসেন। এরপর রাতে হুমায়ুন বাসায় ফিরলে তাকে ভাতের সঙ্গে সেই ঘুমের ওষুধ গুড়ো করে মিশিয়ে দেওয়া হয়। রোববার রাতে পুলিশ কনস্টেবল হুমায়ুন বাসায় ফিরলে তাকে খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু সেই খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল তা জানা ছিল না তার। অবলীলায় সেই খাবার খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন হুমায়ুন। পরে পরকীয়া প্রেমিক মিলে তার গলায় পাটের রশি পেঁচিয়ে হত্যা নিশ্চিত করেন সালমা।
হত্যাকে ভিন্নখাতে নিতে নাটক:
তারা জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডটি ভিন্নখাতে নিতে তারা নাটক সাজান। কারণ তাদের ভয় ছিল ঘরে লাশ থাকলে হত্যা করা হয়েছে বলে লোকজন সন্দেহ করবে। সেই নাটকের অংশ হিসেবে ঘরে সালমাকে লেখে বাইরে থেকে তালা দেন প্রেমিক ও মরিয়ম। পরে তারা যে যার মতো করে চলে যান। কিন্তু তার আগে তারা তিনজন মিলে গভীর রাতে মরদেহটি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামান। পরে তা রাখা হয় সিঁড়ির পাশে থাকা ফাঁকা জায়গায়। তাদের ধারণা ছিল, হুমায়ুনের মরদেহ সিঁড়ির পাশে রাখলে পুলিশ ও লোকজন মনে করবে কেউ তাকে হত্যা করে পালিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে ডেমরা পুলিশের এডিসি আকরামুল হাসান বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত আমরা তার স্ত্রী এবং এক নারীকে গ্রেফতার করেছি। সেই পরকীয়া প্রেমিক এখনও পলাতক। আমরা তাকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছি।
তিনি জানান, পরকীয়ায় আক্রান্ত সালমাকে এই পথ থেকে ফেরাতে স্বামী হুমায়ুন কবির নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি পারেননি। শেষমেষ দুই পরিবার সালমা ও সেই পরকীয়া প্রেমিককে নিয়ে বিচারে বসেন। এটাই ছিল সালমার ক্ষোভ। তাকে কেন সবার সামনে অপমানিত করা হলো। এই ক্ষোভ থেকে মূলত হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
এদিকে এ ঘটনার পর ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আওলাদ হোসেন। তিনি বলেন, হুমায়ুন কবিরের মরদেহ সিঁড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার রাস্তার মাঝে পাওয়া গেছে। তার গলায় কালচে দাগ ছিল। তার স্ত্রী পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি ঘরে তালাবদ্ধ ছিলেন। আমরা তার মাধ্যমে নয়, অন্য লোক মারফতে এই হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েছিলাম।