7.4 C
Toronto
মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৫

ঢাকার মডেলের ফাঁদে চট্টগ্রামের সরকারি কর্মকর্তা, জিম্মি করে ৬০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়

ঢাকার মডেলের ফাঁদে চট্টগ্রামের সরকারি কর্মকর্তা, জিম্মি করে ৬০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় - the Bengali Times
ছবি সংগৃহীত

ধারের ৫ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে চট্টগ্রামের এক সংস্কৃতিকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তাকে ঢাকায় আটকে রেখে আদায় করা হয় ৬০ লাখ টাকা। ঢাকার এক মডেল ও তার বড় বোনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে শুরু হওয়া যোগাযোগ এক পর্যায়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণায় রূপ নেয়— যার পরিণতিতে ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের পাশাপাশি চালানো হয় প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন। শুধু তাই নয়, তাকে নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ছবি-ভিডিও ধারণ করে সামাজিকভাবে ধ্বংস করার হুমকিও দেওয়া হয়।

শুরুতে ‘বন্ধুত্ব’, এরপর শুরু প্রতারণার খেলা
চট্টগ্রামের এক সংস্কৃতিকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তা সম্প্রতি ফেঁসে যান এক ভয়াবহ প্রতারণা ও নির্যাতনের ফাঁদে। বিষয়টি শুরু হয় গত ফেব্রুয়ারিতে, যখন ঢাকার মডেল ও অভিনেত্রী তনয়া হোসেন ও তার বড় বোন তানিশার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে একটি মিউজিক ভিডিওর সূত্র ধরে।

- Advertisement -

মডেল তনয়া হোসেন ওরফে নাজমুন নাহার সুখী ও তার বড় বোন তানিশা রহমান ওরফে কামরুন নাহার আঁখির মাঝখানে আরেক প্রতারক সাফাত ইসলাম লিংকন।
মডেল তনয়া হোসেন ওরফে নাজমুন নাহার সুখী ও তার বড় বোন তানিশা রহমান ওরফে কামরুন নাহার আঁখির মাঝখানে আরেক প্রতারক সাফাত ইসলাম লিংকন।
কয়েকদিনের মধ্যেই তানিশা ফোনে জানান, তার স্বামী দুবাইয়ে গুরুতর দুর্ঘটনায় পড়েছেন এবং চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে অর্থ প্রয়োজন। কিছুদিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১০ লাখ টাকা ধার চান তিনি। ওই সাংস্কৃতিককর্মী পরে ৫ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন।

পরিচয় ‘বসুন্ধরার’— বাড়ি লক্ষ্মীপুর!
২৮ বছর বয়সী তনয়া হোসেন ওরফে নাজমুন নাহার সুখীকে মডেল হিসেবে বিভিন্ন মিউজিক ভিডিও ও ইউটিউবভিত্তিক নাটকে কাজ করতে দেখা যায়। অন্যদিকে তার বড় বোন ৩২ বছর বয়সী তানিশা রহমান ওরফে কামরুন নাহার আঁখিকেও তার সঙ্গে বিনোদন অঙ্গনের বিভিন্ন স্পটে দেখা যায়। তার একটি কন্যাসন্তান আছে। স্বামী দুবাইয়ে থাকেন— এমন কথা বলে থাকেন পরিচিতজনদের। তারা মডেল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লকে বসবাস করলেও তাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরের বড়ালিয়ায়।

দাওয়াতের ফাঁদ ‘টাকা ফেরত নিন’
কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে চট্টগ্রামের ওই সংস্কৃতিকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তা বারবার টাকা ফেরত চাইতে থাকেন, কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে তারা টাকা ফেরত দেন না। এক পর্যায়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তানিশা ফোনে বলেন, টাকা ফেরত দিতে চান, ঢাকায় এসে যেন তিনি নিয়ে যান।

১৯ এপ্রিল অফিসিয়াল কাজে ঢাকা এলে ওই কর্মকর্তা যোগাযোগ করেন। সন্ধ্যায় তানিশা তাকে বসুন্ধরা এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে দাঁড়াতে বলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন, তানিশা নয়, তনয়া নিজে তাকে রিসিভ করেন। তবে তাকে তার বাসায় না নিয়ে, পাশে একটি গলির বিল্ডিংয়ের সাততলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে থাকেন সাফাত ইসলাম লিংকন (২৫) ও তার মা রুমানা ইসলাম স্মৃতি (৫০), যাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।

মিউজিক চ্যানেল অন, হকিস্টিক হাতে দুই যুবক!
ড্রইংরুমে বসানো হলে তনয়া তাকে জিজ্ঞেস করেন খাবেন কি না— এমন প্রশ্নেই তিনি কিছুটা বিভ্রান্ত হন। এরমধ্যেই জোরে টিভিতে গান ছেড়ে দেয় তনয়া। সেই আওয়াজের আড়ালেই হকিস্টিক হাতে দুই যুবক বেরিয়ে আসে ভিতরের রুম থেকে এবং শুরু হয় নির্মম মারধর।

তাকে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে দফায় দফায় নির্যাতন চালানো হয়। ওই কর্মকর্তা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার পাঁচ লাখ টাকা চাই না, শুধু ছেড়ে দেন’। কিন্তু দুর্বৃত্তদের উত্তর— ‘তুই এক কোটি টাকা দিবি, তোরা চিটাগাংয়ের— তোদের অনেক টাকা।’

‘বোনকে ফোন দে, বল ১ কোটি টাকা পাঠাতে’
এরপর তার মোবাইল নিয়ে লাউডস্পিকারে চট্টগ্রামে থাকা বোনকে ফোন দিতে বলেন তারা। ভয় আর চাপের মধ্যে তিনি বলেন, ‘আমার এক কোটি টাকা দরকার, আমি বিপদে আছি ঢাকায়।’ বোন জবাব দেন, “এত টাকা কোথা থেকে আনবো?” তখনই মোবাইল বন্ধ করে ফের মারধর করা হয়।

এরপর ফের ফোন দিয়ে বোনকে বলেন, ‘যা স্বর্ণ আছে বিক্রি করো, ধার করে হলেও এক কোটি টাকা পাঠাও।’ পরে তার বোন ও বন্ধু মিলে মোট ৫২ লাখ টাকা সংগ্রহ করেন।

এসএ পরিবহনে অর্ধকোটি টাকার মুক্তিপণ!
তনয়ার নাম্বারে ফোন করে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই নাম্বারটি ছিল পুরুষের নামে। টাকা দুই কিস্তিতে— ২৬ লাখ করে মোট ৫২ লাখ টাকা পাঠানো হয়। এরপর এসএ পরিবহনের গুলশান-২ শাখা থেকে ফোন পেয়ে তনয়া ও সঙ্গী সেই টাকা সংগ্রহ করেন।

নগ্ন করে ছবি, ভিডিও ধারণ
এই পর্যায়ে প্রতারকচক্র ওই কর্মকর্তার সমস্ত পোশাক খুলে উলঙ্গ অবস্থায় ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। হুমকি দেয়, ‘ঘটনা জানালে এগুলো ফেসবুকে ছেড়ে দিবো, ক্যারিয়ার শেষ করে দেবো।’

রাত ১১টার দিকে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে তার মোবাইল ও ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং একটি গেঞ্জি পরিয়ে গাড়ি থেকে বাড্ডার অন্ধকার এলাকায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়।

অজ্ঞানপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার, পরে মামলা
প্রথম রিকশাচালক ভয় পেয়ে চলে গেলেও, দ্বিতীয় একজন তাকে উদ্ধার করে হোটেলে পৌঁছে দেন। পরদিন তিনি চট্টগ্রামে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হন। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর চট্টগ্রামেরই একজন সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনৈতিক নেতার সহায়তায় গত বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) ঢাকার ভাটারা থানায় গিয়ে সব খুলে বলেন।

অভিযানে গ্রেপ্তার তনয়া-তানিশা, উদ্ধার মুক্তিপণের টাকা
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলামের নির্দেশনায় উপ-পরিদর্শক রুবেলের নেতৃত্বে একটি টিম শুরুতে রাসেলের মোবাইল ট্র্যাক করে তার অবস্থান শনাক্ত করে। শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) রাত নয়টার দিকে প্রথম অভিযান চালানো হয় এভারকেয়ার হাসপাতালের পাশে বসুন্ধরার সীমানা গেইটের পাশের গলিতে অবস্থিত সেই বিল্ডিংয়ের সাততলায়। সেখান থেকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের সদস্য রাসেল ও তার মা স্মৃতি বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় পুলিশ সেই বাসা থেকে মুক্তিপণের ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করে।

এরপর রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে ভাটারা থানার পুলিশ টিম যায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লকে। রাত ১২টার দিকে বিটিআই নির্মিত একটি বিল্ডিংয়ের ছয়তলায় মডেল-অভিনেত্রী তনয়া ও তার বড় বোনের ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় পুলিশ। তাদের দুজনকেও গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। এর আগে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণের ১৩ লাখ ৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

পণের তিন লাখ টাকায় তিন আইফোন
জিম্মি করে আদায় করা ৬০ লাখ টাকার মধ্যে বাকি টাকা কোথায়— পুলিশের তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে মডেল তনয়া ও তার বোন জানান, বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) তিন লাখ টাকা দিয়ে তিনটি আইফোন কিনেছেন তারা। আরও ৮ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

তাদের গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে বিকাশে পাঠানো আট লাখ টাকার সবটাই রাসেলের বিকাশ নাম্বারে জমা হয়েছে। অন্যদিকে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে পাঠানো ৫২ লাখ টাকার সবটাই তনয়া ও তার বোন নিয়েছেন।

চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা
মোট চারজনকে আসামি করে রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলা হয়েছে। এক নম্বর আসামি মডেল তনয়া হোসেন ওরফে নাজমুন নাহার সুখী, দুই নম্বর তার বড় বোন তানিশা রহমান ওরফে কামরুন নাহার আঁখি। বাকি দুইজন সাফাত ইসলাম লিংকন ও তার মা রুমানা ইসলাম স্মৃতি।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles