
দেশের কারাগারে কারাগারে সীমাহীন দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। দুর্নীতিবাজদের চলছে নির্লজ্জ উল্লাসনৃত্য। কে রুখবে এ দুর্নীতি? বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশে উন্নয়নের যে মহাযজ্ঞ চলছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে সেখানে সরকারের বিভিন্ন খাতের দুর্নীতির রাহুগ্রাস সব বিবর্ণ ধূসর করেছে। ঘুষ যেন পদে পদে আজ হালাল হয়ে গেছে। এমন নির্লজ্জ ঘুষ বাণিজ্য ইতিহাসে অতীতে কখনো দেখা যায়নি। সম্প্রতি দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিক নেছারুল হক খোকনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশীদকে তদন্তের সত্যতায় বরখাস্ত করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এই জঘন্য দুর্নীতিবাজের বউয়ের নামে সারা দেশের কারাকর্তারা নিয়মিত কুরিয়ার বা এস এ পরিবহনে লাখ লাখ টাকা এক কথায় কয়েক কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। কারাগারে কারাগারে প্রতিটি খাতে চলে ঘুষ বাণিজ্য। অনিয়ম বিধিলঙ্ঘন সেখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। কারাবন্দি আসামির বাচ্চা হওয়ার সংবাদ পর্যন্ত হয়েছে। এ অনৈতিক অন্যায় অপরাধের সুযোগ কারাকর্তারাই দিয়ে থাকেন। অবৈধ টাকায় তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে কারাগারের ভিতর বা বাইরে কোথায়, একান্ত মিলিত হওয়ার সুযোগ দেন তার তদন্ত আর হয় না। চট্টগ্রাম কারাগারের জেল সুপার থাকাকালে পার্থ গোপাল বণিক সীমাহীন দুর্নীতি করেন। মাদক ব্যবসা, ঘুষ বাণিজ্যের বিশাল টাকাসহ তিনি ধরা পড়ে জেল খাটছেন।
৯ জানুয়ারি তার রায় হবে। কারাগারের ভিতরে দোকানপাট, ক্যান্টিন, খাবার, হাসপাতাল বেডে থাকা এমনকি সেলুন পর্যন্ত দিতে কর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। এক ধরনের নীরব ঘুষবিপ্লব চলছে কারাগার থেকে কারাগারে। যুগের পর যুগ। এ দুর্নীতি বাড়ছেই। কারাগারের ভিতরে নানা দায়িত্বে আছে যারা তাদের সবাইকে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ ছাড়া কারাগারে বাস করার কোনো সুযোগ নেই। আসামিদের জন্য রীতিমতো জাহান্নাম হয়ে যায়। আর ঘুষের বিনিময়ে দর্শনার্থী বিধিলঙ্ঘনই নয়, কারাজীবনকে বিলাসবহুল করে দেন কারাকর্তারা। এতে এক জীবনে তাদের আর কিছুই করতে হয় না। টাকা আর টাকা। রোজ নিয়ত তাদের হাতে ধরা দেয়। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে চরম বিএনপিপন্থি মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি প্রিজন ছিলেন। প্রতাপশালী ওই কর্মকর্তার রাজকপাল খুলে যায় ওয়ান-ইলেভেনের সময়। সব বিত্তবানের প্রিয়পাত্র হয়ে যান সে সময় তিনি। আর তার আয়ের মাত্রা সীমাহীন বেড়ে যায়। সে সময় কারাগারের ভিতরে আসামিদের পছন্দের খাবারই ঢুকত সব পরিমিতিবোধ ও কারাবিধি লঙ্ঘন করে।
এমনকি এসি, কালার টেলিভিশনসহ আলিশান জীবনযাপনের ব্যবস্থা তিনি করে দিতেন অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে। আইনকে সে সময় তিনি তার স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা আর লোভ-লালসায় তামাদি করে দেন। মদ প্রবেশ করত ব্যাপক হারে। বাংলা সিনেমার খলনায়ক ও সে সময়ের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ডিপজল তৃতীয় শ্রেণির কারাবন্দি ছিলেন। কারাবিধি অনুযায়ী ডিপজলের সঙ্গে পরিবারের পাঁচ সদস্য মাসে দেখা করার সুযোগ পান। কিন্তু চরম ক্ষমতাধর মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী এক মাস ১৯ দিনে ৪০০ জনকে দেখা করার সুযোগ করে দেন। ডিপজলের ৭ নম্বর সেলের বারান্দায় সিনেমা জগতের অনেক অভিনেত্রী আর ডিপজলের মাঝখানে মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকীকে প্রাণখোলা হাসিতে দেখা যায়। এমন ছবি তখন গণমাধ্যমেও প্রকাশ পায়। কারাগারে তিনি ডিপজলদের নিয়ে নাচগানের আসরও বসান। অপরাধের জন্য পরে তাকে যশোর কারাগারে বদলি এবং ঢাকায় আনা হয়। কিছুদিন পরই এই বিতর্কিত ব্যক্তিকে অবসরে যেতে হয়।
সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এমন দু-একজন কর্মকর্তাও দায়িত্ব পেয়েছিলেন নিয়মিত যারা নারীর নেশায় উন্মাদ থাকতেন। কোনো তদন্ত বা সংবাদ না হলেও খবর এখনো মুখে মুখে আছে সবার। এদের কুকীর্তি, অপরাধ, অন্যায় কেবল মানুষের মুখে মুখে নয়, সংবাদকর্মীদের আড্ডার আসরেই নয়, কারাগারের দেয়ালে দেয়ালে আর্তনাদ করছে। এরা অমানুষের মতো ক্ষমতার অপব্যবহার করে গেছে। সরকারের উচিত দেশের সব কারাগার ও কারাকর্তাদের ওপর একটি গোপন তদন্ত করা। সেই তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া।
কাশিমপুর কারাগারে জেল সুপার রত্না রায় হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে আটক জেনারেল ম্যানেজার তুষার আহমদকে কারা অভ্যন্তরেই তার বান্ধবীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে দেন। সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ার পর তাকে তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কারাগারে কারাগারে এত দুর্নীতি যে বাতাসে টাকা ওড়ে। এত দুর্গন্ধ যে তা বাইরের বাতাসেও ছড়ায়। অনেক জেলের কর্তাব্যক্তি গোটা পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশে বাড়ি-গাড়ি কিনে বসতি গড়তে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সময় হলেই তারা চলে যাবেন। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর ভৈরব রেলস্টেশনে রেলপুলিশের তল্লাশিতে চেক আর নগদ মেলে প্রায় ৪ কোটি টাকা এবং ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার হন চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা। কারাগারে যত অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, তার নেপথ্যে সক্রিয় থাকেন জেলের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। কারাবন্দিদের জিম্মি করে অন্তত পাঁচ ধাপে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে বন্দি বেচাকেনা, সিট বাণিজ্য, খাবার বাণিজ্য, জামিন বাণিজ্য, সাক্ষাৎ বাণিজ্য ও মাদক বাণিজ্য। কারাগারে মাদক সহজলভ্য টাকার বিনিময়ে। ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে যোগদানের পর সোহেল রানার হাত দিয়ে কোটি কোটি টাকা মাসোহারা পেতেন ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিক ও সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক। দুদক তাদের শেষ পর্যন্ত ছাই দিয়ে না ধরলে তারাও পিছলে যেতেন।
বিদায়ী দুটি বছর আমরা করোনার বিরুদ্ধে লড়েছি। সরকারের সাফল্য এখানে বিস্ময়কর। আমাদের জীবন-জীবিকার লড়াইয়েও আমরা আলোর মুখ দেখেছি। দেশের দেশপ্রেমিক শিল্পপতি, বলবান কৃষক আর প্রবাসী শ্রমিকদের ঘাম-শ্রম-মেধা আমাদের অর্থনীতিকে বিস্ময়কর জায়গায় নিয়েছে। কিন্তু একদল বিশ্বাসঘাতক এই সময়ে গণমানুষের চিকিৎসাসেবা খাতে সীমাহীন লুটপাট করেছে অমানবিক, অমানুষের মতো। এমনকি করোনার টেস্ট নিয়েও তারা ভুয়া রিপোর্ট বাণিজ্য করেছে। মাস্ক নিয়েও বাণিজ্য করেছে অনেকে। হাসপাতালে হাসপাতালে সরবরাহ হয়েছে ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অধিক মূল্যে অকেজো সস্তা মেশিন। কতটাই নির্মম যে এমন কোনো সেক্টর নেই সরকারের যেখানে ঘুষ বাণিজ্য রমরমা নেই। এ দুর্নীতি, এ ঘুষ, এই লুটেরাদের কঠোর শাস্তির আওতায় এনে আইনের কার্যকারিতা না থাকলে কীভাবে সম্ভব লাগাম টেনে ধরা। একজন শেখ হাসিনা আর দেশের একদল সৎমানুষ দেশকে যতই সামনের দিকে টানুন না কেন আরেক দল ডাকাত, বেইমান দুর্নীতিবাজ, নীতিহীন ঘুষখোর, লুটেরা যেন মগের মুল্লুক পেয়েছে। অবৈধ অর্থসম্পদের নেশায় বেহুঁশ এসব চরিত্রহীন দেশটাকে পেছনের দিকে টানছে। দেশের সংবিধান আইন বিধিবিধান কোনো কিছুই মানছে না। মনে করছে আখের গোছানোর সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। যেনতেনভাবে লুটপাট করে অর্থবিত্ত দেশ-বিদেশে পাঠাতে হবে। অবৈধ আয়ে বিলাসী জীবন ভোগ করতে হবে। দেশে ব্যাংক ঋণখেলাপি কত? খেলাপিরা কীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে? কীভাবে তারা ভোগবিলাসের জীবনযাপন করে পার পায়? দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে কারা? এদের নেপথ্য শক্তির উৎস কী? হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুটপাট হয় কেমন করে? তাদের কতজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে? যারা নিয়মিত ব্যাংক ঋণ শোধ করেন, সৎভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তাদের ওপর সুদের চাপ, ট্যাক্সের চাপ, ভ্যাটের চাপ। আর যারা ব্যাংকের ঋণ শোধ করে না, দেশ-বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করে, সমাজে দাপটের সঙ্গে হেঁটে বেড়ায় নির্লজ্জের মতো সমাজ ও আইন তাদের প্রশ্রয় দেয় কীভাবে? যারা দেশের অর্থ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে নানাভাবে পাচার করে তাদের কেন ধরা হয় না? ব্যাংক ডাকাত ও বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে তদন্ত হোক। অপরাধের বিচার হোক। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হোক। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারকারীরা অর্থনীতির শত্রু। দেশের শত্রু। এদের রুখতে হবে। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকেই এদের রুখতে, আইনের আওতায় আনতে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের প্রত্যাশা তার কাছেই বেশি। ঘুষ, দুর্নীতি, তদবির বাণিজ্য, কমিশন বাজিকরদের বিরুদ্ধে একটি সর্বগ্রাসী অ্যাকশন প্রয়োজন। তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কীভাবে অঢেল অর্থসম্পদের মালিক হলো? কীভাবে তারা সব প্রশ্ন ও বিচারের ঊর্ধ্বে? বিশেষ করে একদল আমলা আজ সারা দেশে ক্ষমতাধর ও দাপুটে। তারা কীভাবে বিদেশে বেগমপাড়ায় বিশাল বিশাল বাড়ি কেনে? অর্থ পাঠায়? জামালপুরের ডিসি এত বড় নারী কেলেঙ্কারি করে কেমন করে রক্ষা পান? কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা কীভাবে একজন সংবাদকর্মীকে তার লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে বাসভবনে ধরে নিয়ে বেদম প্রহার করার পরও রক্ষা পান? ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল কামরুন্নাহার মুকুল এত জঘন্য নোংরা কলতলার ভাষা ব্যবহার করেও বহাল থাকেন? দেশের শিক্ষা ভবনই নয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও তার ভিসিরা পর্যন্ত নিয়োগ বাণিজ্যসহ দুর্নীতির কলঙ্ক মাথায় নিয়ে আইনের আওতায় এলেন না! এভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রাম নেতৃত্ব ও ডাকে লাখ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশকে একদল দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরকে লুটতে দেওয়া যায় না। ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অভিযানে জনগণকেও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিতে হবে। সমাজকেও অপরাধীদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। বলতে হবে ওই যে ঘুষখোর যায়। ওই যে দুর্নীতিবাজ যায়। ওই যে চোর যায়। ওই যে সস্তা ছ্যাঁচড়া নষ্ট লোভী যায়। লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন