
কড়া দুপুরবেলায় বাইরে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না।
প্রচন্ড ঘরমে, ঘামে হাসফাস লাগে। অলস পায়ে হাঁকতে থাকে সিলভারের হাঁড়ি-পাতিলওয়ালা কিংবা কাগজওয়ালা। পাশের সজনে গাছে কর্কশ গলায় ঝগড়া মারামারি করবে কিছু ভাত শালিক। আমগাছের কমলা রঙের চিরুনি সদৃশ পরগাছা ফুলের মধ্যে ধরাধরি খেলবে ছোট্ট টুনটুনি পাখির দল। আর অর্কিড নামিয়ে দেবে অপরূপ সাদা-আসমানী রঙের লম্বা ফুলের গোছা।
দুপুরে খিদে আরও পাকাপোক্ত হতে থাকে; যখন রান্নাঘর থেকে খাঁটি সর্ষে তেলে রান্নার গন্ধ ছোটে। ধনেপাতা ছিটানো, সবুজ কাঁচা টমেটোর ফালি দিয়ে কাঁচকি মাছের ঝোলের নির্ভূল গন্ধে ভরে উঠবে সারা বাড়ি। পাশের হাঁড়িতে টকবক করে ফুটতে থাকবে মোটা চালের ভাত। সবুজ চকচকে কচু শাক কড়াইতে সেদ্ধ হয়ে আসলে ছেড়ে দেয়া হবে ভেজে গুঁড়ো করা ডালের বড়ি আর টেলে নেয়া পাঁচফোড়ন। মসুরের ডালে দেয়া হবে বাগাড়। ছুটবে পাঁচফোড়নের বাষ্প।
চোখ আটকে যাবে নতুন আলু দিয়ে ভাজা কড়কড়ে উচ্ছে ভাজির দিকে। হয়ে উঠবে সেলিব্রিটি। পরিমানে অল্প, আর মুচমুচে হবার কারনে সবাই সাবধানে অল্প করে পাতে নিয়ে গরম ভাতের সাথে মাখিয়ে শুরু করবে; বিসমিল্লাহ বলে। শাক ঘন্টের বড়ির গুঁড়োগুলো তখনও থাকবে মুচমুচে। এই ঘন্ট অল্পতে কখনও মন ভরে না।
তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হবে জাদুকরী টক স্বাদের কাচঁকি মাছ আর মসুর ডালের রুচিবর্ধক আহার। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ডালের মধ্যে ভাসবে কড়কড়ে পাতলা উচ্ছে ভাজা। চুমুকের সাথে আস্ত কেঁচকিগুলো ঝর্ণাধারার স্রোতের সাথে সাঁতরিয়ে অন্ননালী দিয়ে নেমে ঝাঁপ মেরে আত্মাহুতি দেবে গভীর প্রশান্তিময় জলাধারে!
নদীর ধারের গ্রাম কিংবা শহরগুলো খুব ভাগ্যবতী।
বিকালে নদীর ধারে, খোলা বাতাসে হাঁটার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠবে। বাঁধে পৌঁছে দেখা যাবে শত শত মানুষ আড্ডা দিচ্ছে, বাদাম খাচ্ছে, প্রেম করছে। লোকজন নৌকায় উঠার জন্য মাঝির সাথে দরদামে ব্যস্ত।
নৌকায় উঠে বসতেই চলতে শুরু করবে ঐ দূরে; কাশবনে, বালু চরের দিকে। নৌকার কিনারে বসে স্বচ্ছ ঠান্ডা পানিতে হাত চুবালে নদী হাত টেনে ধরে বলে- নেমে এসো হে বৎস, ঝাপিয়ে পড়ো আমার বুকে! একটাদিন ছেলেবেলার ফিরে গেলে ক্ষতি কি! পানির ছোঁয়ায় মনটা খুশিতে ভরে উঠবে।
ভ্যাপসা গরমে প্রকৃতি যেন মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। চরের বালু নিয়ে খেলা করবার সময় হঠাৎই পশ্চিম আকাশে দেখা যাবে কালো মেঘের ঘনঘটা। মেঘের চাদরে ঢাকা সূর্যটা তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করবে ফাঁকফোকর গলে উঁকি দিতে। ধেয়ে আসবে কুচকুচে কালো মেঘের শক্তিশালী সুনামি! যেন চেঙ্গিস খানের হিংস্র লক্ষাধিক সৈন্যবাহিনী, টগবগে ঘোড়ায় চেপে ধুলোর ঝড় তুলে তলোয়ার হাতে ছুটে আসছে সব ছাড়খাড় করতে। আলো-আঁধার সংঘর্ষের ভয়াবহ রণক্ষেত্র থেকে চোখ ফেরানো অসম্ভব। সারা আকাশ জুড়ে চলবে যুদ্ধের ডামাডোল। তীব্র কৌতুহল চারিদিকে। ভয়ের সাথে বিজয়ের বাঁধভাঙ্গা আনন্দের এক বর্ণনাতীত সন্ধিক্ষণ! যেকোনো মুহূর্তে সব লন্ডভন্ড করে দিতে প্রস্তুত।
শুধু সময়ের ব্যপার!
হঠাৎ পিনপতন নীরবতা ভেঙে শুরু হয়ে যাবে তীব্র বাতাস আর ধুলোর ঝড়। চোখে ধুলো ঢুকে জ্বালা করবে। আশপাশে দৃষ্টিসীমা হয়ে আসবে সীমিত। শুরু হবে ঝমঝমে বৃষ্টির তান্ডব, কান ফাটানো বজ্রপাত! থান্ডায় কাবু করে দেয়া হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। যেন রাত নেমে এসেছে।
কি যে প্রশান্তি!
আধা ঘন্টার মধ্যে আবার সব শান্ত।
মাঝি ছুটে আসবে যাত্রীদের তুলে নিয়ে বাঁধে ফেরৎ নিয়ে যেতে। নুইয়ে থাকা কাশবন মাথা তুলনার চেষ্টা করবে। সূর্যটা আবার উঠে এসে এমন ভাব করবে যেন কিছুই হয়নি! ঠান্ডা হাওয়ার পরশে শেষ বিকেলের সূর্য হাই তুলে, চারদিকে রং ছিটিয়ে শান্তিতে ঢলে পড়তে থাকবে প্রশান্তিময় রাতের কোলে..
অটোয়া, কানাডা