10.8 C
Toronto
শুক্রবার, মে ২৩, ২০২৫

অচেনাকে চেনা

অচেনাকে চেনা - the Bengali Times
এত দীর্ঘ পথ গল্পের মাঝে আমার বই পড়া মুভি দেখা সময় মতো খাবার খাওয়া কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি ও নানারকম কাজকর্ম চলতে থাকে

চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়, পরিচয় হয়। কখনো কয়েক ঘণ্টার জন্য বা কখনো কয়েক দিনের জন্য। কত গল্প কত আন্তরিকতা,কত কথা, গল্প করতে করতে মনের অনেক কথা খুলে বলা। তারপর মানুষটি হারিয়ে যায় কোনোদিন আর দেখা হয় না। পথের সাথী পথের মাঝেই হারিয়ে যায়। এমন ঘটনা আমার জীবনে অনেক ঘটেছে। কোথাও কোনো যাত্রাপথে কিংবা জীবনে চলার পথে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় তারপর সে বন্ধুত্ব সেখানেই শেষ। কিছু কিছু ঘটনা ছাড়া অন্যসব পরিচয়, ক্ষণিকের বন্ধুত্ব সে মুহ‚র্তেই আমার মন থেকে মুছে যায়। তবে কিছু কিছু কয়েক ঘণ্টার পরিচয় মনে বেশ দাগ কেটে থাকে।

বাংলাদেশে যাচ্ছি এমিরাত এয়ার লাইনে। টরন্টো থেকে দুবাই চৌদ্দ ঘণ্টার ফ্লাইট তারপর কয়েক ঘণ্টার বিরতি, আবার দুবাই থেকে ঢাকা পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট। আমি মোটামুটি প্রতি বছরেই দেশে যাই, কখনো মাটির টানে, কখনো মায়ের টানে, কখনো বইমেলাকে সামনে রেখে। এবার আমি যাচ্ছি বইমেলাকে সামনে রেখে। সবকিছু গুছিয়ে রেখে আমার নির্দিষ্ট উইন্ডো সিটে গিয়ে বসলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পাশে দুজন ভদ্রলোক এসে বসলেন। আমি কিছুটা অস্বস্তি ও অনেকটাই বিরক্তি বোধ করতে লাগলাম। কিন্তু কিছু করার নেই। ফ্লাইট ভরা আর কোনো সিট খালি নেই। তারপরও আমরা একে অপরের সাথে সৌজন্য হাসি বিনিময় করলাম। কারণ আগামী চৌদ্দ ঘণ্টা আমরা এক সাথে আকাশে উড়বো।

- Advertisement -

প্লেন আকাশে উড়ে গেলো। আমি আমার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। আমার পাশের ভদ্রলোক আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনার যখন উঠার দরকার হবে আপনি কিন্তু কোনো দ্বিধা বোধ করবেন না, আমরা উঠে যাবো আপনার বের হবার জন্য। তাছাড়া বেশিক্ষণ বসে থাকাটাও কিন্তু ঠিক না। পায়ে সমস্যা হয়। তারপর হেসে বললেন, জানেন তো বøক কিন্তু শুধু হার্টে হয় না, পায়েও হয়। আমি মজা করেই জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বুঝি হার্টের ডাক্তার? ভদ্রলোক লজ্জিত হাসি হেসে জবাব দিলেন, জী!

গল্প একটু একটু এগুতে থাকে। এত দীর্ঘ পথ গল্পের মাঝে আমার বই পড়া, মুভি দেখা, সময় মতো খাবার খাওয়া, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি ও নানারকম কাজকর্ম চলতে থাকে। চিকিৎসক ভদ্রলোক অনেকটা সময় ঘুমিয়ে উঠলেন। আমার বড় সমস্যা আমি কখনো ভ্রমণ পথে ঘুমাতে পারি না। সেটা যতো দীর্ঘ পথই হোক না কেন।

কথায় কথায় আমাদের গল্প বেশ জমে উঠলো। ভদ্রলোক একজন হৃদযন্ত্রের চিকিৎসক, আমেরিকার একটি শহরে সপরিবারে থাকেন। স্ত্রীও চিকিৎসক, তবে অন্য বিষয়ক। আমেরিকাতে পড়াশুনা। পড়তে পড়তে স্ত্রীর সাথে পরিচয়, প্রণয়, তারপর বিয়ে। বিয়ে আমেরিকাতেই হয়। পরিবারের আপনজনেরা এসেছিল বিয়েতে। দুই পরিবারের সদস্যরা দুই দেশে থাকে বলে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তাছাড়া আরো একটি কারণ ছিল, সেটা হলো তার স্ত্রী কখনো বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তার এই সিদ্ধান্ত ছিল? ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মানুষের জীবনে অনেক সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা কি-না মন থেকে কোনোদিন মুছে ফেলা যায় না। আমার আগ্রহ আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। আমি উৎসুক হয়ে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

তিনি নিজে থেকেই বলতে লাগলেন আমাকে পুরো ঘটনা। তার স্ত্রীর পরিবারের সবাই বাংলাদেশের মানুষ। বাবা-মা সবার জন্ম বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। বাংলা স্কুলে পড়ে বাংলাতে কথা বলে, বাঙালি বন্ধু-বান্ধব-পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে মিলেমিশে আনন্দ উৎসবে তাদের জীবন ভালোই কাটছিল। অন্যদের মতো তাদের মনেও ছিল বাংলাদেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। দেশ স্বাধীন হয়েছে সে পরিবারটি এতে অনেক আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ওদের বাড়িতে ঘন কালো মেঘ জমে উঠল। কালবৈশাখী ঝড় তাদের বাড়িটিকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তছনছ করে তাদের নিঃস্ব করে দিলো।

দেশ কেবলি স্বাধীন হয়েছে জনতা, উচ্ছৃঙ্খল। মানুষের মনে চলছে প্রতিশোধের আগুন। সবার হাতে হাতে অস্ত্র। কান কথা শুনে ঝাঁপিয়ে পড়া হচ্ছে একেকজনকে নিশানা করে। মূল উদ্দেশ্য লুটতরাজ। সে পরিবারটির দোষ ছিল এই পরিবারের পূর্ব পুরুষেরা ‘বিহারী’ নামে পরিচিত ছিলেন। যদিও সেটা নিয়ে সে পরিবারের সদস্যদের কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। এসব ভাবনা তাদের মনে কখনো আসেই নি। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাতে একদল যুবক ঢুকে পড়লো তাদের বাড়িতে। তুই বিহারি বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার স্ত্রীর বাবার উপরে। একজন ভদ্রলোককে যতটা নিম্ন মানের অপমান করা যায় তারা সেটাই করলো।

বাড়ির কাজের লোকদের মারধোর করলো তারা যেন বের হয়ে কাউকে ডাকাডাকি না করতে পারে। আমার স্ত্রী তখন খুবই ছোট। সে এবং তার দু’ভাইয়ের ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার কান্নাতে একটি হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সন্ত্রাসীরা তার বাবাকে হুমকি দিয়ে যায় সাত দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে নাহলে সবাইকে গুলি করে মারা হবে। যাবার সময় তাদের গাড়িটা একজন যুবক বাবার কাছ থেকে চাবি নিয়ে চালিয়ে চলে যায়। কিছু ঘণ্টার মধ্যে বাবার সখ করে বানানো আর মায়ের মনের মতো সাজানো বাড়িটি আর যে বাড়িটিতে তারা তিন ভাই-বোন আনন্দ খুশিতে বেড়ে উঠছিল সে বাড়িটি পরিণত হলো পোড়ো বাড়িতে। চোখের সামনে লুট হয়ে গেলো পুরো বাড়িটা।

ঘটনা ঘটে যাবার পরে বন্ধু বান্ধবরা অনেকেই ছুটে এসেছিল। এই বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে বাবার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সবাইকে তার বাড়িতে নিয়ে রাখেন। তখন দেশে কোনো আইন নেই, বিচার নেই। সবার হাতে তখন বিচারের দণ্ড। কে কার কথা শুনে? আমার স্ত্রীর বাবার বন্ধুরা অনেক সাহায্য সহযোগিতা করলেও তার বাবা আর থাকলে চাইলেন না বাংলাদেশে। লজ্জা, অপমান, নিরাপত্তাহীনতা, ক্রোধ তাকে অসুস্থ করে তুললো। তিনি আর পেছন ফিরে তাকালেন না। বাংলাদেশের বন্ধুদের এবং ভারতের এক বন্ধুর সহযোগিতাতে তিনি সারা জীবনের জন্য সপরিবারে দেশ ছাড়েন। তারপর অনেক পরিশ্রম, অনেক কষ্টে নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন তার বাবা-মা। ওরা ভাই-বোনেরা তাদের বাবার দীর্ঘশ্বাস আর মায়ের চোখের জল দেখে দেখে বড় হয়েছে।  পরর্বতীতে তাদরে জীবন ভালোই কেটেছে। তার স্ত্রী আমেরিকাতে এসে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন।’

কথা শেষ করে ভদ্রলোক আবার হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, দেখুন তো কেমন করে আপনাকে আমার স্ত্রীর জীবন কাহিনী শুনিয়ে দিলাম। আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। চৌদ্দ ঘণ্টা কেটে গেলো। প্লেন দুবাই বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। ভদ্রলোক উপর থেকে আমার ব্যাগ নামিয়ে দিয়ে সাহায্য করলেন। আমি চলে গেলাম আমার আগেই বুকিং করা এয়ারপোর্ট হোটেলে। ভদ্রলোক কোথায় গেলেন জানি না। সাত ঘণ্টা পরে দুবাই ঢাকা ফ্লাইট। সময় মত এসে গেলাম প্লেন ধরার জন্য। প্লেনে চড়ে বসলাম। বসে ভ‚ত দেখার মতো চমকে উঠলাম। চিকিৎসক ভদ্রলোক আবারো আমার পাশের সীটে। দুজনই দুজনকে দেখে সশব্দে হেসে উঠলাম। পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেলো।

এবার আর কোনো পারিবারিক কথা হলো না। গান সাহিত্য এসব নিয়ে গল্প হলো। ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় থাকবেন ঢাকাতে? তিনি বললেন, বনানী। আমি বললাম, আমি গুলশান, দেখুন আবার কোথাও হয়তো দেখা হয়ে যাবে আপনার সাথে। দু’জন দু’জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার উনিশ ঘণ্টা একসাথে পাশাপাশি বসে গল্পগুজব করে কাটালাম অথচ কেউ কারো নাম জিজ্ঞাস করলাম না। জিজ্ঞেস করা হল না যোগাযোগের মাধ্যম। এই এক অদ্ভুত কয়েক ঘণ্টার বন্ধুত্ব। যেখানে আমরা কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলাম না কোনো যোগাযোগের। জীবনে হাজারো ব্যস্ততায় মাঝে মাঝে মনে পড়ে সে হৃদযন্ত্রের বিশেষ চিকিৎসক ভদ্রলোকের কথা, যার নাম আমার জানা হলো না।

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles