হজ, ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম ও এমন একটি ইবাদত যা শারীরিক, আর্থিক ও আত্মিক ত্যাগের এক অনন্য নিদর্শন। হজের এই মহাসম্মেলনে নারী-পুরুষ উভয়ে অংশগ্রহণ করেন; তবে শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কিছু বিধি-বিধানে রয়েছে সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য, যা ইসলামের শালীনতা, নারীর সম্মান ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নির্ধারিত হয়েছে।
নারী-পুরুষের মাঝে বিধানগত পার্থক্যের তাৎপর্য
হজের বিধানে নারীদের জন্য যেসব ব্যতিক্রম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত তাদের স্বভাবগত নম্রতা, লজ্জাশীলতা এবং নিরাপত্তা রক্ষার্থে। ইসলাম নারীকে সম্মানের চূড়ান্ত শিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাই হজের মতো বৃহৎ সম্মেলনেও নারীর মর্যাদা যেন অক্ষুণ্ন থাকে, সে দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
১. মাহরাম ছাড়া নারীর হজে যাওয়া নিষেধ।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন—
لا تسافر المرأة إلا مع ذي محرم
নারী মাহরাম ছাড়া সফর করবে না।(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৬২)
এই হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নারীর হজে যাওয়ার পূর্বশর্ত হলো মাহরাম পুরুষের সঙ্গে থাকা। এটি নারীর নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। যদিও পুরুষের ক্ষেত্রে এই শর্ত নেই।
২. নারীর ইহরাম ও পোশাকের পার্থক্য
পুরুষদের জন্য ইহরামের পোশাক দুটি সেলাই বিহীন সাদা কাপড় (তাদের শরীরের কিছু অংশ খোলা থাকে)। নারীদের ইহরাম হলো তাদের স্বাভাবিক পর্দাসম্মত পোশাক যেন তাদের সৌন্দর্য ঢাকা থাকে। তারা কোনোভাবে সাজসজ্জা করতে পারবে না, এবং মুখে নিকাব বা হাতে দস্তানা পরবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন—
ولا تنتقب المرأة المحرمة ولا تلبس القفازين
ইহরাম অবস্থায় নারী নিকাব পরবে না, দস্তানা পরবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৩৮)
৩. নারীদের তাওয়াফ ও সাঈ করার ধরণে ভিন্নতা
পুরুষেরা তাওয়াফের সময় ‘রমল’ বা দ্রুত চলার হালকা চেষ্টায় থাকেন প্রথম তিন চক্করে; নারীদের জন্য এমনটি সুন্নত নয়। তেমনি সাফা-মারওয়ায় সাঈ করার সময় পুরুষেরা সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ে চলেন (হারওলা), নারীরা দৌঁড়াবে না বরং সম্মান ও শান্ত ভঙ্গিতে হাঁটবে।
৪. শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ
নারীরা অস্বাভাবিক ভিড়ের মধ্যে যেন বিপদে না পড়ে, তাই তাদের জন্য শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের সময় স্বস্তিদায়ক সময়ে যাওয়া উত্তম ও জায়েয। সাহাবায় কিরাম ও তাবেয়ীগণ নারীদের জন্য এ সুবিধা প্রদান করেছেন।
৫. খুতবা শোনা ও ভীড়ভাট্টা বিষয়ক পার্থক্য
পুরুষেরা আরাফার ময়দানে ইমামের খুতবা শোনেন, কিন্তু নারীরা ভিড়ের কারণে দূর থেকে অবস্থান করলেও তা যথেষ্ট। এই ছাড় নারীর নিরাপত্তার প্রতি ইসলামের সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
৬. চুল কাটার নিয়মে পার্থক্য
হজ শেষে পুরুষেরা মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করেন, অথচ নারীদের জন্য মাথা মুণ্ডন নয়; বরং চুলের সামান্য অংশ (প্রায় এক আঙ্গুল পরিমাণ) কেটে দেওয়াই যথেষ্ট। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে—
فَإِذَا قَضَيْتُم مَّنَاسِكَكُمْ
তোমরা যখন হজের কার্যাদি সম্পন্ন করো… (সূরা বাকারা, আয়াত : ২০০)
এই আয়াত ও হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, নারীদের জন্য শরীয়ত পূর্ণ মর্যাদার সাথে সহজ পন্থা নির্ধারণ করেছে।
ইতিহাসের প্রেক্ষিতে…
হজরত ফাতিমা রা., উম্মে সালামা রা., আয়েশা রা. প্রমুখ নারী সাহাবিরা হজ আদায় করেছেন, কিন্তু তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ছিলেন মাহরাম এবং তাদের সম্মান-রক্ষার্থে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, নারীদের হজ আদায়ে পুরুষদের তুলনায় কিছু বিধান ভিন্ন হওয়াই প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রতি দয়া ও সহজতার বহিঃপ্রকাশ। (শরহ মুসলিম)
ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কে আল্লাহর ইবাদতে একসাথে আহ্বান করেছে, তবে তাদের স্বভাব, শারীরিক গঠন ও সামাজিক নিরাপত্তা অনুযায়ী কিছু বিধান পৃথক করেছে।
হজে নারীদের জন্য যেসব ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে, তা কেবলই তাদের প্রতি রহমত ও কল্যাণের বিবেচনায়। ইসলামের এই চিরন্তন সৌন্দর্য আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর প্রতিটি হুকুমে রহমত নিহিত রয়েছে।