14.2 C
Toronto
শনিবার, মে ১৭, ২০২৫

স্মৃতিকথা : প্রথম ছেলের জন্ম ও মৃত্যুর সময় হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন নিশ্চুপ

স্মৃতিকথা : প্রথম ছেলের জন্ম ও মৃত্যুর সময় হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন নিশ্চুপ - the Bengali Times
গুলকেতিন খান

বিয়ের পর আমি হলিক্রস কলেজে ভর্তি হই। প্রথম বর্ষের শেষের দিকে বুঝতে পারি যে আমি conceive করেছি ( মা হতে যাচ্ছি)।

আমাদের প্রথম কন্যা নোভার জন্মের পর এইচ এসসি( তখন ইন্টারমিডিয়েট বলা হতো) পরীক্ষার এক/দেড় মাস আগে নোভাকে নিয়ে Americaতে রওনা দেই (তবে হুমায়ূন আহমেদের লেখা “ হোটেল গ্রেভার ইন” এ যে লিখেছিলেন তাঁর লেখা চিঠি পড়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে America রওনা হয়েছিলাম, সেটা সত্যি ছিলো না)সবাইকে চিঠি লিখেও যখন আমি Americaতে যেতে রাজি হইনি তখন আমার দাদা, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে একটি চিঠি লিখেন তিনি।

- Advertisement -

চিঠিতে কী লেখা ছিলো জানিনা তবে দাদা আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত রেখে বলেন,”বিদেশ ভ্রমনও শিক্ষার একটি বড় অংশ”। দাদার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস আমার ছিলো না!
যাইহোক ব‍্যাক্তিগত কারণে আমি পরীক্ষার এক মাস আগে America চলে যাই। হুমায়ূন আহমেদের PhD এর পর এক বছর Post doctoral Fellowship করে আমাদের দেশে ফেরার কথা ছিলো। NDSU( North Dakota University) তে কিছু কোর্স ছিলো যেগুলো High School এর। আমি তিনটি কোর্স করেছিলাম। Maths, Physics Chemistry. সব গুলোতেই ৯০ এর নাম্বার পেয়েছিলাম। ওঁ বলেছিল এধরনের কোর্স করতে পারলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবো হয়তো! কিন্তু Post Doctoral Fellowship এর পাঁচ মাসের মাথায়ই ব‍্যাক্তিগত কারণে দেশে ফিরে আসতে হয়! দেশে ফেরার দেড় মাসের মধ‍্যে আমাদের তিন নাম্বার কল‍্যা বিপাশার জন্ম হয় PG(বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হাসপাতালে)। কয়েক বছর পার হয়ে ১৯৮৭ সালে আমরা শহীদুল্লাহ হলে (তিনি house tutor হওয়ার পর ) তারপর আবার Humanity group থেকে পরীক্ষা দিয়ে নানারকম ঝামেলা পার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।

কয়েক মাস পার হতেই আমি বুঝতে পারি যে আবার মা হতে যাচ্ছি। আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে! আমার শাশুড়িকে দেখেছি যে, তিনি তাঁর বড় ছেলেকে সংসারের সব ঝামেলা থেকে দূরে রাখতে। তাই আমিও তাই করি।তিন কল‍্যারা তিন স্কুলে পড়তো, অনেক ঝামেলা করে তাদের এক স্কুলে(Holly Cross) এনেছি। সকালে উঠে ওদের স্কুলের জন্যে তৈরি করা বেশ কঠিন। স্কুলের কাপড় পরার পরই আমাকে দ্রুত গতিতে ৬টি বেনী করতে হয়! ওদের স্কুলে পাঠিয়ে দুপুরের খাবারের কথা ভাবতে হয়।ভাজাভুজি, ভাত, ডাল আকবরের মা রান্না করলেও মাছ, মুরগি অথবা মাংস আমাকেই রান্না করতে হয়।কন‍্যদের বাবা রান্না ভালো না হলে খেতে পারেন না এবং প্রায়ই বন্ধুদের নিয়ে খেতে পছন্দ করেন।

আমার দাদা ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাশ, মা’ও ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স পড়তেন। আর আমি কী সারাজীবন ম‍্যাট্রিক পাস হয়ে থাকবো? অনেক কষ্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি! এখন আবার পড়াশোনা বন্ধ করতে হবে? হুমায়ূন আহমেদের তখন তিন নাম্বার ধারাবাহিক নাটক লেখার কথা হচ্ছিল। আমি তাঁকে অনুরোধ করি নাটকের কাজ কিছুদিন পরে করতে !

সে রাজি হলোনা, তাঁর নাকি তখনই লিখতে ইচ্ছে করছিল! আমাদের মধ্যে কথা ছিলো এরকম-তাঁর পড়াশোনার সময় আমি সাহায্য করেছি তাই আমার পড়াশোনার সময় সে আমাকে সাহায্য করবে! কিন্তু সে তাঁর কথা রাখছেনা! এদিকে আমার আগের প্রেগন্যান্সিতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবার আমার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। খাওয়া নিয়ে তো অসুবিধা হচ্ছিলোই তার সঙ্গে অন‍্যান‍্য আরো কিছু উপসর্গ ছিলো। একটু পর পর মুখে থুথু জমা হতো! বাসায় থাকলে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু ক্লাসের সময় কী করবো? তখনো টিসুবক্স দেশে পাওয়া যেতো না। আমি বড় একটি কাধে ঝোলানো ব‍্যাগে অনেক পুরানো পত্রিকা রাখতাম, থুথু কাগজে ফেলে পলিথিনের ব্যাগে রাখতাম। শরীরের গঠনের জন্যে অনেকদিন পর্যন্ত কিছু বোঝা যায়নি। তারপরও আমি খুব চওড়া সুতির ওড়না পরতাম।

হুমায়ূন আহমেদের সব নাটকের শুটিং এ আমি যেতাম।এবারের নাটকে আমাদের তিন নাম্বার কন‍্যাও অভিনয় করছিল। এর মধ্যে ঈদে সবার জন্যে যখন নতুন কাপড় কেনা হলো তখন চতুর্থ কন‍্যা, রাত্রির জন‍্যেও জামা কেনা হলো। হুমায়ূন আহমেদকে USIS থেকে Americaর Iowa তে তিন মাসের জন্যে পাঠানো হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে লেখক আসবেন সেখানে। তাঁর পোষাক সাধারণত আমি কিনি।সুটকেসের দায়িত্ব নিয়েছেন মুনির ভাবী, তাঁরা নিউমার্কেটের খুব কাছে থাকেন (যদিও “মে ফ্লাওয়ার” , হুমায়ূন আহমেদের ব‍্যাক্তিগত জীবন নিয়ে লেখায় “সুটকেস আমার কেনা” লিখেছেন)।

হুমায়ূন আহমেদ তখন খুবই ব্যস্ত কারণ তিন মাসের নাটক লিখে, অভিনয় পর্বগুলো দেখে তিনি যাবেন। আমাকেও নাটক পড়ে দেখতে হবে আগের পর্ব গুলোর repetition যেনো না থাকে!
আমার কন‍্যার জন্মের তারিখ পার হয়ে গেছে ( প্রতিবারই এমন হয়), আমরা দুজনেই ডাক্তারের কাছে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ডাক্তার সাহেব আর কিছু দিন পরই আমি দেশের বাইরে যাবো। আমি কি আমার বাচ্চাকে দেখে যেতে পারবো না?
ডাক্তার সাহেব বললেন, কালকে সকাল ৮টার মধ্যে আমার ক্লিনিকে চলে আসবেন।
ততদিনে একজন প্রকাশক লেখককে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছেন। আমি ৮টার অনেক আগেই রেডি। একটু পর পর বলছি, ৮টা প্রায় বেজে যাচ্ছে। অবশেষে আমরা ক্লিনিকে পৌঁছালাম ৮:০৫ এ অর্থাৎ ডাক্তারের নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট পর! শুনলাম উনি ঠিক ৮টায় চলে গেছেন। আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করিতে হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন নাটকের outdoor শুটিংয়ে। কয়েকজন অল্প বয়সী ডাক্তার এবং নার্স কিছুক্ষণ পর পর আমার পালস্, হার্ট বিট এবং বাচ্চার হার্ট বিট check করছেন। ১১:৩০ এর দিকে একজন duty ডাক্তার অথবা নার্স ডাক্তারকে ফোন করে বললেন বাচ্চার হার্ট বিট irregular! আমার সাথে আত্মীয় স্বজন কারা ছিলেন কিছুই মনে পড়ছে না কারণ সকাল থেকেই আমার কিছু ভালো লাগছিলো না! কেনো যেনো খুব মন খারাপ লাগছিলো। শুনলাম ডাক্তার সাহেব ২টা থেকে ৩টার মধ্যে এসে operation করবেন। উনি এলেন রাত ৯টার দিকে। ততক্ষণে হুমায়ূন আহমেদ outdoor এর কাজ শেষ করে দলবল নিয়ে ক্লিনিকে চলে এসেছেন। এরপরের ঘটনা আমার তেমন মনে নেই, শুধু মনে আছে আমাকে কেউ একজন injection দিয়েছেন।

মাঝরাতে মনে হলো একটি পুরুষ কন্ঠে কেউ বলছেন, এই যে শুনতে পাচ্ছেন? আপনার তো ছেলে হয়েছে! তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ি!
সকালে ঘুম ভাঙে, দেখি চেয়ারে বসে আছেন লেখক সাহেব। আমার খুব কাছে এসে বললেন,”গুলতেকিন, তোমার তো রাজপুত্রের মতো ছেলে হয়েছে! কী চাও তুমি”? আমি ক্লান্ত গলায় বলি,”কিছু না”।
“তোমাকে খুব সুন্দর একটা diamond এর আংটি কিনে দিবো”! আমি মনে মনে ভাবি,” ছেলে হলে কেনো diamond এর আংটি দিবে?”
প্রায় ঘন্টা খানেক পরে একজন নামকরা Pediatrician( বাচ্চাদের ডাক্তার) আমার পাশের চেয়ারে বসেন।
বলেন,” আপনি বোধহয় শুনেছেন, আপনার ছেলে MAS এ ভুগছে! আমরা একটি মেডিকেল
বোর্ড তৈরি করেছি। কিন্তু আপনি তো তার “মা”, তাই আপনিও ওর কাছে বসে একটু দোয়া করেন!
আমি কিছু না বুঝে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকি।
উনি আমাকে বুঝিয়ে বলেন। অনেক সময় বাচ্চারা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি যদি মায়ের পেটে থাকে তখন একটি খাবার খায়। ঐ খাবারটি তার নিজের poop! বেশি খেয়ে ফেললে এবং suction machine দিয়ে তখনই বের না করলে বাচ্চার অবস্থা খুব খারাপ হয়! মেডিকেল টার্মে এটাকে বলা হয়”Maconium Aspiration Syndrome! উনি মাথা নিচু করে বসে থাকেন।

আমি ধীরে ধীরে উঠে বসি।একজন নার্সকে বলি আমাকে বাচ্চার কাছে নিয়ে যেতে।আমি হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠি। বিশাল একটি ঘরে ছোট্ট একটি কাচে ঘেরা বাক্সে ঘুমিয়ে আছে আমার ছেলে! আমি হাত তাকে ছুঁতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা! কী দোয়া করবো আমি? ফিরে আসি অন‍্য একটি ঘরে।
তিন দিন বয়সে brain hemorrhageএ সে চলে যায় না ফেরার দেশে! এই তিন দিনে আর কী কী হয়েছিলো, আমি জানি না।শুধু মনে আছে আমার কোলে একটি ধবধবে সাদা towel রাখা হয়েছিল। তারপর আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আমার পরিচিত ঘরে।

তিন দিন পর তার কুলখানি হয়! বাসা ভর্তি মানুষ! আত্মিয় স্বজন ছাড়াও অভিনয় জগতের অনেক মানুষ। আমাকে কুলখানির তেহারি দেয়, নিজের ছেলের কুলখানির খাবার আমি খেতে পারিনি, আমার বমি আসে!
আমার ঘরে একা বসে থাকি। একেকজন একেকরকম সান্ত্বনা দেয়। একজন বলেন, নিষ্পাপ শিশু মারা গেলে বেহেশতে যায় এবং মাকেও সাথে নিয়ে যায়!
আমি সারাদিন বিছানায় বসে ভাবি, আমি জেনে শুনে কখনো কোনো অন‍্যায় করিনি! আল্লাহর কাছে ছেলেও চাইনি! কেনো আল্লাহ আমাকে তাহলে এতো কষ্ট দিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ চলে যান Iowaতে। আর তিন চার দিন পরে আমার First Year final পরীক্ষা!
পরীক্ষার দিন, বাচ্চারা সবাই স্কুলে। আমি বসে ভাবতে থাকি কী করা উচিৎ? আমি best friend রিংকুকে ফোন করি।
:রিংকু, তুমি পরীক্ষা দিতে যাবার সময় uncleকে বলো আমাকেও তুলে নিতে!
:সত্যি আপনি যাবেন?
: হ‍্যা যাবো। যদি বসে থাকতে হয়, তাহলে বসেই থাকবো! তবেএকটি শর্ত আছে! আমার রোল নাম্বার তোমার চেয়ে চার জনের পর। আমি তোমার পেছনে বসবো কিন্তু তুমি কখনো পেছন ফিরে তাকাবে না!
:কেনো?
:পরে বলবো।
আমরা চার তলায় যাবো।
ইতিমধ্যেই আমার খবর ছড়িয়ে গিয়েছে। আমাকে চার তলায় যেতে দিবে না কেউ! নীচে sick bed এ বসে পরীক্ষা দিতে বলছেন সবাই।
আমি হেঁটে হেঁটে চারতলায় গিয়ে সিট নাম্বার মিলিয়ে বসি।
চারটা প্রশ্নের উত্তর লেখার কথা। আমি লিখছি আর চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে, কেনো তা জানিনা!
চারটার থেকে সাড়ে তিনটার উত্তর লিখলাম। তারপর পেছনের সিঁড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিচে নামলাম!
আমার সন্তানরা যেনো আমাকে দেখে শিখে যে জীবনে যতই ঝড় আসুক পড়াশোনা শেয করতেই হবে!

লেখক: কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী ।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles