
মা রেগে আছেন, তবে সেই রাগ বাবার সামনে প্রকাশ করছেন না। রাগ প্রকাশ করছেন রান্নাঘরের হাঁড়ি পাতিলের সাথে।
ভোরবেলা বাবাকে মা পাঠিয়েছেন বাজারে, আমার ঘরে বসেই বাজারের লিস্ট করেছে। বাবা সব বাজার ঠিকঠাক নিয়ে এসেছে, তবে বাজারের সাথে একটা ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা একটা চোখে দেখে না, রোগা অনেকটা। আট নয় বছরের মতো বয়স হতে পারে।
বাবা মায়ের হাতে বাজার দিয়ে বলেন, নূর এই ছেলেটা আমাদের সাথে কিছুদিন থাকবে। আমার মায়ের নাম নূরজাহান, তবে বাবা ডাকে নূর বলে। বাবা মাকে বলেন, পাশের ঘরে ওর বিছানা করে দিবে। ছেলেটার নাম রানা, বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। পলাশ পুর বস্তিতে চাচার সাথে থাকে। এই যে চোখে ক্ষত হয়েছে এটা ওর চাচার মারের কারণেই। ছেলেটা বাজারের পাশে বসে কাঁদতেছিলো দেখে খুব মায়া হলো, তাই বাড়িতে নিয়ে আসলাম। ভালো করছি না?
মায়ের কাছে বাবার এই ধরনের কাজ পছন্দ না। বাড়িতে যাকে খুশি তাকে নিয়ে আসা মা মোটেও পছন্দ করেন না।
মা বাবাকে ডেকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বলে, এই ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসবার কি দরকার ছিলো? বরং কিছু ওষুধ কিনে দিয়ে দিতে, বাড়িতে চলে যেতো।
বাবা হেসে বলেন,থাকুক না হয় এখানে কিছুদিন।
মা বলেন, তোমার কখনো শিক্ষা হবে না? বাবা বলেন সবাই তো খারাপ হয় না নূর। মা বলেন সে দেখা আছে এর আগেরবার বলেছিলে সবাই খারাপ হয় না। তবে সে কি করলো? তোমার ব্যাংক থেকে তোলা টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলো, ভাগ্য ভালো আমার ভাই পুলিশে তাই টাকা পেয়ে গেছো নয়তো কি হতো?
বাবা বলেন, এই ছেলেটা ছোটো মানুষ। কয়েকদিন থাকুক, তারপর যদি খারাপ কিছু দেখি বিদায় করে দিবো। বলে দিবো, তোমার পথ তুমি দেখো বাবা।
রানা আমাদের সাথেই থাকে, আমরা দুই বোন এক ঘরে থাকি। কখনো রুমের দরজার পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের ভিতরে আসে না। আমি বা আয়েশা ডাক দিলে তখন চুপচাপ এসে টেবিলের পাশে দাঁড়ায়।
বাবা একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। রানার চোখের সমস্যাটা ভালো হয়না, তাই চোখে চশমা পরতে হয়।
পড়াশোনায় ছেলেটা তেমন মেধাবী না, তবে মোটামুটি একটা রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে। বাবা আমাকে ডেকে বলেন, শোন শুচিতা তুই রানাকে পড়াবি। পারবি না? আমি বলি পারবো।
বাবা আমাকে আর আমার ছোটো বোন আয়েশাকে ভাগ করে দেয়। আয়েশা তিনদিন আর আমি তিনদিন রাতে রানাকে পড়াই। সপ্তাহে একদিন ছুটি। সে সন্ধ্যায় রান্না ছাদ থেকে জোনাকিপোকা ধরে নিয়ে কাঁচের বৈয়ামে রাখে, সেই কাঁচের বৈয়াম নিয়ে চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকে।
রানা যখন এসএসসি পাশ করে মা বলে, এই ছেলেকে এবার বিদায় করে দিতে। তবে বাবা বলে, কলেজে ভর্তি হোক তারপর কোনো একটা হোস্টেলে তুলে দিয়ে আসবো। বলে দিবো, বাবা এবার তুমি তোমার পথ দেখো আর পারছি না আমি।
রানাকে বাবা কলেজে ভর্তি করায়, তার এক সপ্তাহ পরেই আমার বিয়ে ঠিক হয়। বাড়িতে বিয়ের উৎসব। বাবা যেনো রানাকে বাড়িতে রাখবার জন্যে কয়েকটা দিনের আরো কিছু বাহানা খুঁজে পায়। বাবা মাকে বলেন, বিয়ের এই কয়টা দিন থেকে যাক? মা আর না করেনি।
আমার বিয়ের আটমাস পরেই আয়েশার বিয়ে হয়। রানা তখনও আমাদের বাড়িতে থাকে।
যখন আমাদের বাসায় যাই, বাবা তখন বলে কলেজ থেকে পাশ করলেই রানাকে বিদায় করে দিবো কি বলিস তোরা? মা বলেন, তুমি সেইতো কবে থেকে বিদায় করে দিচ্ছো আর কবে বিদায় করবে?
বাবা মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে অন্য কথায় চলে যায়।
আমার বর সুমন দেশের বাহিরে চলে আসে ওর আপার কাছে। কিছুদিন পরে আমাকে নিয়ে আসে। আয়েশাও দেশেরর বাহিরে থাকে এখন, আমরা পাশাপাশি শহরেই। মাসে দুই একবার দেখা হয়।
মা বাবার সাথে ফোনে কথা হয়, তবে দীর্ঘদিন পরে একবার দেখবার সুযোগ হয় সামনাসামনি।
বাড়িতে এখন থাকে বাবা মা এবং রানা।
রানা কলেজ থেকে পাশ করবার পরে চট্টগ্রাম বিশব্বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়।
রানা যেদিন চলে যাবে সেদিন মা কান্না করে দেয়, এতোদিন মা চেয়েছিলো রানাকে তাড়িয়ে দিতে তবে আজকে ছেলেটার জন্যে তার মায়া লাগছে।
বাবা ট্রেনে তুলে দিয়ে আসে, তবে অদ্ভুত সেই রানা পরের ট্রেনে ঢাকা ফিরে আসে। রাত গভীরে বাবা দরজা খুলে দেখে রানা দাঁড়িয়ে আছে। বাবা এবং মা রানার কাছে ফিরে আসবার কারণ জানতে চায়নি। তারা জানে এই ছেলেটা কেন ফিরে এসেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রানার ভালো সাবজেক্ট আসেনি, তবু সেই সাবজেক্টেই ভর্তি হয়ে যায়। সারাদিন যেখানেই থাকুক সন্ধ্যা হলে বাসায় ফিরে আসে।
রানার ফিরতে দেরি হলে মা দুঃশ্চিন্তা করে। আমি রানাকে একটা স্মার্টফোন কিনে দেই, দেশে আমার এক কলিগ গেলে তার কাছেই রানার জন্যে একটা ফোন পাঠিয়ে দেই। প্রায়দিনই ভিডিও কলে কথা হয়।
বাবা মাকে ছেড়ে রানা কখনো যায়না, রানার দেশের বাহিরে স্কলারশিপ হয়। বেশ খুশি হয়ে আমাদের সবাইকে সেই খবর দেয়।
তবে সেই খবর শুনে বেশি মন খারাপ করে আমার মা। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে।
অদ্ভুত রানা সেবার দেশ ছেড়ে যায়নি। বাবা মায়ের কাছেই থেকে গেছে। এই ছেলেটাকে যত দেখি ঠিক ততবারই অবাক হই।
রানাকে যদি কখনো জিজ্ঞেস করি, এমন ভালো সুযোগ ছেড়ে দিলি কেন? রানা হেসে বলে, আপা তোমাদের বাবা মায়ের কাছে আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত থাকতে চাই। দেখবে দেশেই আমার ভালো কিছু হবে! জীবনে তো খুব বেশি টাকার প্রয়োজন আমার নেই। আমার মাথায় এই দুইজন মানুষের দোয়া আছে, মোটামুটি কিছু একটা হলেই হয়ে যাবে।
রানার বিয়ে উপলক্ষে আমরা দুই বোনই পরিবার নিয়ে দেশে আসি। সেদিনের সেই ছোট্ট রানা রানা একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। রানার সাথে মেয়েটা পড়তো সেই মেয়ের সাথেই ওর বিয়ে হয়। মেয়েটার নাম হেলেন, একটা কলেজে শিক্ষকতা করে। দুজনকে বেশ মানিয়েছে, রানার বউয়ের জন্যে আমরা দুই বোন মিলে গহনা নিয়ে এসেছি, রানা গহনা দেখে মুচকি হাসে, ছেলেটা লাজুকও আছে।
রানা বাবা মাকে যদিও বাবা মা ডাকে না। তবে হেলেন বাবাকে বাবা এবং মাকে মা ডাকে।
মানুষ বুঝতেই পারেনা রানার সাথে আমাদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। যদিও সম্পর্কটা কেবলই আত্মার। হেলেন আর মায়ের সাথে সম্পর্ক দেখলে মনে হয় হেলেন যেনো আমাদের সবার ছোটো বোন।
বাবা ভয়ে ছিলো দুই মেয়ের বিয়ের কিভাবে তারা একা থাকবে তবে এখন বাবা মাকে দেখলে মনে হয় মানুষ দু’জন আনন্দে বেঁচে আছে। এই আনন্দ রানা এবং হেলেন রেখে দিয়েছে এই ঘরে। ছেলেটা জোনাকিপোকা নিয়ে ছোটোবেলায় আমাদের ঘরে বসে থাকতো, এখন বাবা মায়ের কাছে আলো হয়ে থেকে যায়। বাবা মা কেউ অসুস্থ হলে চিন্তা হলে তখন তারা বলে, শুচিতা তুই চিন্তা করিস না হেলেন আছেতো আমার পাশে। হেলেন ফোন নিয়ে বলে, আপা আপনি ঠিকমতো খাবার খান, নিজের শরীরের যত্ন নেন আমরা আছিতো। আমি হেলেনের কথা শুনে হাসি, মেয়েটা আমার চেয়ে বয়সে বেশ ছোটো তবে মনে হয় আমার বড় বোন।
রানাকে প্রথমে আমার পছন্দ হয়নি, তবে এখন শুচিতার ভাই রানা এই কথাটা শুনলে ভালো লাগে। রানা আমার ভাই।
শুচিতার ভাই।