
স্যার দায়িত্ব দিয়েছেন পুষ্প কেনার। তিনি এই মহান দেশ কানাডা নিয়ে একটি বই সম্পাদনা করেছেন এবং আমরা একঝাঁক লেখক নিজেদের মতো করেই লিখেছি। আজ তার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। আমি খুব উচ্ছ্বসিত কারন আমার মতো পাতি লেখকের কাছে নিজের যে কোনও মুদ্রণই বড়ই উৎসাহের বিষয়। তা পুষ্প কিনতে গিয়ে যত বিপত্তি। তা হল যেখানেই যাই আজ মা দিবসের ছড়াছড়ি। পুষ্পের গায়েও মা দিবসের ছাপ্পা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের পুষ্প কোথা থেকে কিনি?
মেজাজ সঙ্গত কারনেই তিরিক্ষি হয়ে যাচ্ছে। আমি দিবস পালনে তেমন একটা বিশ্বাস করি না। যদি তা কোনও ব্যাক্তির থাকে সম্পৃক্ত থাকে তাহলেও একটা কথা হয় যে অমুক দিবসে এই ব্যক্তি পৃথিবীতে পদার্পণ করেছে তাই তার জন্য বিশেষ একটি দিন আলাদা করে রাখা হল। তাই জন্মদিন কিংবা বিবাহের দিন পালন করা যেতেই পারে তাও মোটামুটি ব্যক্তিগতভাবে। কিন্তু এই মা দিবস, বাবা দিবস, নারী দিবস , দুলাভাই দিবস – এগুলি আমার কাছে বা্যবসায়িদের মুনাফা লুটের সুযোগ ছাড়া আর কিছু মনে হয়না। বিশেষ করে আমাদের অশ্বেত মানুষদের জন্য এই দিবস পালন ন্যাকামি ছাড়া আর কি হতে পারে?
শ্বেত মানুষদের কথা আলাদা। তাদের সংস্কৃতিতে বসবাসকারী অশ্বেত মানুষের কথাও আলাদা। বেশ কিছু বছর আগে টরন্টোর এক বিখ্যাত বৃদ্ধাশ্রমে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতাম সপ্তাহে তিনদিন। সেখানে দেখেছি প্রবীন অথর্ব হয়ে যাওয়া মায়েদের হাহাকার। মাসের পর মাস কেটে যায় তাদের ছানাগুলো মা বাবাকে দেখতে আসে না। তবে হ্যা বছরের এই একটা দিন তারা মিস করে না আর তা হল মা দিবসে একতোড়া পুষ্প এবং পরিবার পরিজন নিয়ে ঠিকই হাজির হয় মা কে দেখতে। এই দিনটির জন্য তীর্থের কাকের মতো মা অপেক্ষা করে থাকেন। একবেলা একটা মিল একসাথে খেতে পারার সৌভাগ্য ঘটে এই দিনটিতে। তাই এই দিনের তাৎপর্য অবশ্যই অনেক অনেক বেশি।
মা দিবস পালন করা উচিত সেই দিনেই যেদিন একজন নারী মা হন। কারও জন্মদিন পালন করার সাথে সাথে সেদিনটি সেই মাকেও উদযাপন করা উচিত কারন একটি সন্তান পৃথিবীতে নিয়ে আসার এবং তাকে সমাজের জন্য উপযুক্ত করে তৈরী করার গুরুদায়িত্ব মা-ই পালন করে থাকেন। আমরা সবসময় উল্টোটা করি, যার জন্ম হয়েছে তাকে উদযাপন করি কিন্তু যিনি জন্ম দিলেন তাদের সকলের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে তারপর পালন করি। আমরা এমন উল্টো কেন?
মা দিবস পালন না করার পেছনে আমার ব্যক্তিগত কিছু দুর্বলতাও আছে। আমি মানুষ হিসেবে প্রচন্ড হিংসুটে। আমার নিজের মা আমাদের ফেলে পালিয়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। আমার নিজের কোনও সন্তান নেই, মায়ের মতো মানুষগুলোও কেমন দূরে দূরে আছেন।
যে কোনও সাধারণ দিনেই বন্ধু বান্ধবের মায়েদের আহ্লাদ দেখলে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। মনে হয় গলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে স্পন্দনরত হৃদপিন্ড বের করে এনে সৃষ্টিকর্তাকে দিয়ে বলি আমার এই হৃদপিন্ডটা রেখে দিয়ে তার বদলে একটা দিন- মাত্র একটা দিন আমার মায়ের সাথে কাটানোর সুযোগ দিন। আমি আর একটা দিন কোমড় বেঁধে মায়ের সাথে ঝগড়া করতে চাই, আদর করতে চাই,তার হাতে একবেলা ভাত খেতে চাই পেট ভরে- কতদিন খাই না।
মা- দিবসের পুষ্প এবং ভিনদেশি মানুষের আদিখ্যেতা দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে উঠি। মনে হয় গালি দিয়ে বলি ওহে মূর্খের দল, পুষ্প নয়, পৃথিবীর সকল সময় সকল ভালোবাসা মায়ের জন্য উৎসর্গ করো। কারন মা এত অল্প সময়ের জন্য থাকেন আমাদের সাথে, আর যাদের মা বেশি সময়ের জন্য থাকেন তাদের মতো সৌভাগ্যবান আর কে হতে পারে?
আমার মা- অত্যন্ত সাহসী এবং স্পর্শকাতর মানুষ। চোখে পড়ার মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং একজন গভীর জলের মাছ। তাঁকে বুঝতে হলে একটি দুটি নয়, অন্তত পনেরোটি সাক্ষাৎ প্রয়োজন ছিল। অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ আমার মা একা হাতে পুরো পরিবারের জাহাজের বয়ে নিয়ে গেছেন বহুদূর। যখন আমাদের বানের জলে ভেসে যাওয়ার কথা ছিল তখন তাঁর শক্ত মানসিকতার জোরে বেঁচে গেছি আমাদের নিজেদের সহ আরও বহু বহু পরিবার।
পৃথিবীর সকলের কাছেই তাঁদের মা সেরা। মা হিসেবে সকলেই সেরা। বাজি ধরে বলতে পারি মা হিসেবে তাড়কা রাক্ষসীও তাঁর সন্তানদের জন্য সেরা। আমার মাকে মা হিসেবে না ভেবে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে চেস্টা করি সবসময় এবং এটাই খুঁজে পাই যে তিনি মানুষ হিসেবে অনন্যা।
কিন্তু আমি আমার মাকে ফেরত চাই। আসমান জমিন এক করে হলেও চাই। মৃত্যুর পরে অসীম পরকালে হলেও চাই। আমার সকল নশ্বর অবিনশ্বর স্থাবর অস্থাবর সকল কিছুর বিনিময়ে হলেও চাই। আমি সর্বদা সর্বত্র আমার মাকে খুঁজি। জীবনের উপরে মৃত্যুর হুমকি এলে কিংবা পেঁয়াজ কাটতে যেয়ে আঙুল কেটে ফেললে কিংবা প্রিয় মানুষেটার বকা খেয়েও আমি মাকে খুঁজি। যখন বিধাতা সকল দরজা বন্ধ করে দেন আর সামনে অন্ধকার দেখি তখনই মাকে খুঁজি। আবার যখন জীবনে চরম আনন্দের কিছু ঘটে, সপ্তাশ্চর্যের একটি সামনে যেয়ে দাঁড়াই, পরম আনন্দে স্বাদ গ্রহন করি কোনও ভিনদেশী খাবারের তখনও মাকে খুঁজি। আমার ধারনা মা হারা সকল বাচ্চারাই খোঁজে।মৃত্যুর আগ অবধি খুঁজতে থাকে। মা একবার হারিয়ে গেলে সেই বাচ্চার জীবন পৃথিবীতে তার বাকি সময়ের জন্য অপূর্ণ থেকে যায়।
কথাগুলো বলার পরে মনে হলো খুব বিচারকসুলভ (জাজমেন্টাল) কথা বলেছি। কিন্তু সবসময় মনের আবেগ সমাজের নিয়মানুবর্তিতার মোড়কে বেঁধে রেখে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মধ্যে মনে হয় বলেই ফেলি মনের কথা। কার কি-ই-বা এসে যায়? যার যার ইচ্ছে মা দিবস পালন করতেই পারেন।আমার মতো হিংসুটিদের আবেগঘন হাবিজাবি চিন্তা দিয়ে কারও কিছু যাবে আসবে না। যারা মাকে সেলিব্রেট করতে চান করতেই থাকবেন- করে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাঁপাবেন আর তাই দেখে আমার মতো মা-হারা বুড়ো বাচ্চারা গোপনে চোখের পানি ফেলব এই যা।
পৃথিবীর সকল মাকে শ্রদ্ধা এবং বুকভরা ভালোবাসা।
স্কারবোরো, কানাডা