
আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে রেডি হয়ে এসে মোবাইলে সার্চ দিলাম- Dollarama near me. বাসার পাশেরটা বন্ধ হয়ে গেছে। দূরেরটায় যেতে হবে, সেটা মাত্র দেড় কিলো।
আমরা বের হয়ে বাসার পেছন দিয়ে রাস্তায় উঠে বললাম- বুড়ি, এই পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না? ঐ দেখ দূরে, পানির ট্যাংক! তার মানে সোজা গেলে ওয়ালমার্ট পাবো। আর ওখান থেকে কোয়ার্টার কিলোমিটারের মধ্যেই ডলারামা।
মেয়েটা আমার হাত ধরে হেসে ফেলে বলল, আব্বু আমি তোমার হাত ধরলে লজ্জা লাগে?
– খুউব!
– বাবা!
আমিও মাঝে মাঝে একই ফান করি; পাবলিকের মধ্যে হঠাৎ তার হাত ধরে বলি, বুড়ি তুই লজ্জা পাচ্ছিস না তো! তার স্কুল এলাকায় সে কোনোমতেই হাত ধরবে না।
এখন প্রায় আঠারো ডিগ্রি।
একটা সুন্দর নেইবারহুডের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। কি সিন্দর আবহাওয়া। গাছে গাছে সবু পাতা বের হওয়া শুরু হয়েছে। এই হালকা সবুজ দারুন এক সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে আসে। অনেক বাড়ির সামনে টিউলিপ ফুটেছে। সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে। প্রকৃতি জেগে উঠছে দিগুণ গতিতে। ছয় মাস বরফ আর ঠান্ডায় মৃতপ্রায় প্রকৃতি সুদে-আসলে তুলতে চায়।
এদিকের বাড়িগুলা বেশ বড়। দখিনা জিজ্ঞেশ করল- আব্বু এই বাড়িগুলা কি খুব এক্সপেন্সিভ?
– তা তো হবেই। দেখ ব্যাকইয়ার্ড কতো বড়! দেখ খরগোশ!
– কি কিউট!
আমরা বাড়িটার পেছন দিকে তাকিয়ে বিশ্ময়ে অবাক হয়ে যাই। অনেক বড়ো উঠোন বাড়ির পেছনে। সেখানে আবার কয়েকটা ছাপড়া তোলা। তাও অফুরন্ত জায়গা। আমাদের ছয়টা বাড়ি এঁটে যাবে।
আব্বু, আমরা টিউলিপ ফেস্টিভাল এ কবে যাবো?
– নেক্সট উইকেন্ডে। জানিস আজকে আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড টরন্টো থেকে আসছে অটোয়ায় টিউলিপ ফেস্তিভ্যাল এ। সকালে এসে দেখে আবার বিকালে ব্যাক করবে। প্রায় নয়শো কিলোমিটার ড্রাইভ, আর যদি ঘোরাঘুরি করে, হাজার কিলোমিটার টোটাল!
– বলো কি!
– আরও দূর থেকেও মানুষ আসে।
সামনে একটা স্টপ সাইন দেখে দখিনা বলল- আব্বু, তুমি কি ওই স্টপ সাইনে থামবা?
– হু
– এরকম ফানি কাজ করলে আমি আর তোমার সাথে হাঁটবো না! গাড়ি থামবে, তুমি কেন থামবা? প্লিজ আব্বু, সিলি কাজ করবা না!
তার কথা না শুনে আমি ঠিকই স্টপ সাইনে থেমে গেলাম গম্ভীর মুখে। সে আমার হাত ধরে টেনে টানাটানি করতে লাগলো। মেয়েটা এতো মিষ্টি করে হাসে!
আমরা মিনিট দশেকের মধ্যে ইনেস রোডে উঠে ডলারামা দেকানে ঢুকে তাকে সতর্ক করে করলাম; আজকে শুধু গিফএ এর ব্যাগ কিনবি, আর কিচ্ছু না কিন্তু!
– অকে বাবা।
কালকে তারা অনেক খরচ করেছে। সময়ের অভাবে শুধু গিফট এর ব্যাগ কেনাটাই নাকি ছিল। সে কয়েকটা ব্যাগ হাতে আমার সামনে মেলে ধরে বলল, আব্বু দেখোতো কোনটা, চুজ করো
– যেটা তোর পছন্দ সেইটা
– না তুমি বলো।
চিন্তা করে সোনালী কাজ করা ফুলের মধ্যে একটা লেডিস সাইকেলের ছাপ মারা ব্যাগ পছন্দ করলাম। আশ্চর্য, ঠিক এরকম একটা বাইসাইকেলই তার মায়ের আছে। বললাম, এইটা!
– অকে বাবা!
সে অন্যগুলো রাখতে গিয়ে আরেকটা বের করে এনে বলল, দেখো আব্বু আরেকটা পাইছি, এইটা কতো সুন্দর? এ দুটার মধ্যে কোনটা নিবো?
অনেক ক্যাল্কুলেশন করে সাইকেলেরটা বাদ দিয়ে বললাম, ফুলেরটাই নে, এতো সুন্দর!
সে মহা খুশি হয়ে ফুলেরটা নিল, সাইকেলের ছাপ মারাটা রেখে আসলো। ফুড সেকশনে গিয়ে স্টার বাকস কাঁচের বোতলের কফি খুঁজতে লাগলাম। এক কিশোর কাজ করছিল; তাকে বললাম, আচ্ছা তোমাদের আর ফ্লেভার নাই? ক্যারামেল বাদে?
– আমি এনে দিচ্ছি।
আমার মেয়ে ক্যারামেল একদম পছন্দ করে না।
ছেলেটার বয়স কতো হবে? পনেরো বা ষোলো? এখনই কাজ করা শুরু করে দিয়েছে?
সে ভেতরে গিয়ে মকা ফ্লেভারের কফি নিয়ে আসলো। একটা দখিনার হাতে দিতেই সে মহা খুশি।
মেয়েটা অল্পতেই খুব খুশি হয়। তার ভাইয়ের জন্য চিপস আর মায়ের জন্য তিনটা লাল টকটকে গোলাপ সচ্ছ পলিথিনে প্যাক করা গিফট নিল। যদিও আসল গোলাপ না, চকলেট দিয়ে তৈরি।
লম্বা লাইন, কালকে মাদারস ডে এর জন্য অনেকেই কেনাকাটা করছে শেষ মুহূর্তে। আমাদের ঠিক সামনে এক বাবা তার ১০-১১ বছরের কন্যার সাথে গল্পকরছে আর মুখে লেগে থাকা ময়লা মুছে দিচ্ছে। বাংলায় বললাম, আম্মু দেখ ঐ মেয়েটার বাবাও টাক!
– বাবা!
– টাক মানুষ দেখে আমার কেমন জানি লাগে, হিহি!
– উফ বাবা!
আমরা বাইরে এসে তার কাঁধের ছোট ব্যাগের মধ্যে সবকিছু ঢুকিয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকি। তার মাকে সে আগেই এগুলো দেখাবে না।
প্রচন্দ বাতাস।
আমার মাথা থেকে ক্যাপ উড়ে যাবার উপক্রম। ক্যাপ মাথায় চেপে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, খাইছে রে আম্মু! বাতাস যদি আমার ক্যাপ উড়ায়ে নিয়ে যায়, তখন সবাই যে আমার টাক দেখে ফেলবে!
– তাইতো! ভালো করে ধরে রাখো আব্বু!
– ক্যাপটা লুজ হয়ে আছে। দাঁড়া, ঠিক করে নেই।
মাথা থেকে ক্যাপ খুলে হাতে নিয়ে ক্যাপের বেল্টটা টাইট দিতে থাকি। দখিনা খিলখিল করে হাসতে থাকে। বলে- আব্বু তোমার টাক কী আরও বড়ো হইছে? সবাই যে দেখে ফেললো?
– দেখুক গা। আমার কী, সবাই বলবে দখিনার বাবার মাথায় টাক! রে রে…
আবার মাথায় পরে বললাম, এইবার টাইট, বাতাসে আর উড়বে না
– তুমি এতো ফান করতে পারো আব্বু! আই লাভ ইউ!আব্বু?
– হু
– কাল তুমি দাদিকে ফোন করবা। দাদিকে আই লাভ ইউ বলবা।
আমরা গল্প করতে করতে বাসার সামনে আসতেই দখিনা গাড়ির পেছনের হুড খুলে কালকের কেনা লিকানো মায়ের গিফ্টগুলো বের করে নিয়ে বলল- আব্বু, তুমি আগে ভেতরে ঢুকে দেখো আম্মু কোথায়। আম্মু যেন দেখে না ফেলে।
আমি সাবধানে দরজা খুলে ভেতরে ধুকে এদিক-ওদিক চেয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, নাই!
উপরে সেলাই মেশিন চলার আওয়াজ। সে প্রায় নি:শব্দে পা টিপে টিপে গিফ্টগুলো নিয়ে উঠতে থাকে সিড়ি বেয়ে তার ঘরের দিকে। ওগুলো সে লুকিয়ে রাখবে, সুন্দর করে প্যাকেট করে ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে তার মা কে দেবে!
আমার মা হইছে একটা!
অটোয়া, কানাডা