22.7 C
Toronto
শুক্রবার, মে ১৬, ২০২৫

মা

মা - the Bengali Times
আমার মা আমার পৃথিবী আমার কাছে আমার মা জ্যোৎস্নার আলোর চেয়েও সিগ্ধ আমার মায়ের হাসি আমার কাছে চাঁদের আলোর চেয়ে সুন্দর

পৃথিবীর সব চাইতে মধুর শব্দ হলো মা। মা শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে বুকের ভেতর একটা শীতল পরশ অনুভব করে সবাই। মা মানেই স্নেহের পরশ, ভালোবাসার পরশ। সবকিছু সন্তানের জন্য বিলিয়ে দেবার নামই যেন মা। পৃথিবীতে মাকে নিয়ে কতো কাব্য কতো কবিতা কতো গান। মা হলেন নিরাপদ আশ্রয় ও ভরসার স্থান। মা নামের ছোট্ট শব্দটার বিশালতা আকাশ ছোঁয়া। মা শ্বাশত, মা চিরন্তন। মায়ের স্নেহধারায় সিক্ত হয়ে গড়ে উঠে প্রতিটি সন্তান। মায়ের আশীর্বাদ সন্তানকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করে। একমাত্র মা-ই পারেন সন্তানের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে। পৃথিবীতে কি এমন কেউ আছে যে মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারে? সন্তানের দুঃখ, কষ্টে বিপদে মা হতে পারেন সাথী। সন্তান উপবাস থাকলে মা মুখে খাবার তুলতে পারেন না। সন্তানের বিপদে একমাত্র মায়েই পারেন নিজের জীবন বিপন্ন করে ছুটে যেতে। মায়ের তুলনা কোনোকিছুর সাথে হতে পারে না। কিন্তু দুঃখ এখানেই, আমরা কজন সন্তান মায়ের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারি। যদি পারতাম তাহলে হয়তো বৃদ্ধা আশ্রমের অপেক্ষার তালিকা দিনদিন বাড়তে থাকতো না। নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব মায়ের জীবন বিপন্ন করে তুলতো না। সন্তানের বাড়িতে সবার জায়গা হলেও মায়ের স্থানটি খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন মায়ের চোখের জলই হয় তার একমাত্র ভরসা। সন্তানরা ভুলে যায় বাবা-মায়ের আত্মত্যাগ, পরিশ্রমের ফলে তারা আজ এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। মা কখনো সন্তানের প্রতি নিষ্ঠুর হতে না পারলেও, অনেক সন্তানেরই খুব সহজেই মায়ের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখাতে তাদের বিবেকে বাধে না।

আমার মা আমার পৃথিবী। আমার কাছে আমার মা জ্যোৎস্নার আলোর চেয়েও সিগ্ধ, আমার মায়ের হাসি আমার কাছে চাঁদের আলোর চেয়ে সুন্দর। আমাদের মা এখনো আমাদের মাঝে আছেন। মায়ের বয়েস ৮১ বছর। প্রতি বছর মায়ের টানে বাংলাদেশে যাই। মায়ের সাথে সময় কাটাই। মা আমাদের সব সময় সুশিক্ষা দিয়েছেন যতদিন আমরা মায়ের অধীনে ছিলাম। বাবার মতো মাও আমাদের আগলে রেখেছেন তার বুকে। যখনই দেশে গেছি তখনই মনে হয়েছে মা-তো আছেন আমার আর কী চিন্তা। মা-ই তো আছেন, আমার সবকিছু মা-ই তো দেখবে। আমার আর কোনো দায়-দায়িত্ব নাই। এ এক বিশাল নির্ভরশীলতা। এখন মায়ের অনেক বয়েস হয়েছে। বার্ধক্যজনিত কারণে নানারকম অসুস্থতাতে জড়িত। তারপরেও যখন দেশে যাই মুখেমুখে নানারকম নির্দেশ দিতে থাকে কাজের লোকদের, কোনোভাবেই যেন আমার কোনো অসুবিধা না হয়। চিন্তিত থাকেন আমার কী খেতে ভালো লাগবে না, লাগবে এসব নিয়ে। আমার মনে হয় আমার মাথার উপরে মা একটা বিরাট ছাতা। যা কি-না আমাকে ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করবে। মা ছাড়া আর কার কাছে এই নির্ভরতা পাওয়া যায়? আমার কাছে আমার মা বৃষ্টি শেষের শীতল হাওয়া।

- Advertisement -

মায়ের জীবনটা নিয়ে একটু কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আমার মা একজন শিক্ষিত আধুনিক মহিলা ছিলেন। মাকে কখনো আমরা অগুছালো অবস্থাতে দেখিনি। ঘুম থেকে উঠেই মা সুন্দর করে চুল বাঁধতেন, খোপা করতেন, তাতে কাঁটা গুজতেন। পরিপাটি করে শাড়ি পরে তারপরে সংসারের কাজ শুরু করতেন। পরিপাটি করে সংসার করেছেন সারাজীবন। আমরা বিরক্তি অনুভব করেছি অনেক সময় মায়ের এমন টানটান করে ঘর গুছিয়ে রাখার বাতিক দেখে।

আমার মা বই পড়তে অনেক ভালোবাসতেন। দুপুরে খাবার পরে মা একটা ‘বেগম’ মহিলাদের ম্যাগাজিন এবং পরবর্তীতে ‘বিচিত্রা’ বা অন্যান্য গল্পের বই পড়তে পড়তে দিবানিদ্রাতে চলে যেতেন। আর সেটা ছিল নাক ডেকে গভীর নিদ্রা। আমার মায়ের আর একটা মজার ব্যাপার ছিল, মা ঘুমের মধ্যে প্রচুর কথা বলতেন। সেটা দুপুরের ঘুমেও। সে কথাগুলো এমন ছিল, যেন মা জেগে বসে কারো সাথে কথা বলছেন। ঘুমের মধ্যে আমাদের সবার নাম ধরে ডাকতেন। বিকেলে চায়ের সাথে কি নাস্তা দিতে হবে কাজের লোকদের ডেকে বলতেন। আরো কত কথা। মায়ের এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছিল। যদিও মায়েদের কথা লেখার জন্য আমি মা বলছি কিন্তু আমরা মাকে আম্মা বলে ডাকি। আম্মা অত্যন্তÍ ভালো মনের একজন মানুষ। আম্মা ছোট বড় নিজের বয়েসই সবার সাথে জমিয়ে গল্প করতে পারেন। আম্মার সাথে কথা বলে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খুব কমই আছে। কী সহজেই না আম্মা সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। এখনো আম্মা একা থাকতে পারেন না। মানুষজন সবাই আম্মাকে ঘিরে থাকুক সেটা আম্মা চান। যদিও সব সময় সেটা সম্ভব না। সবার নানা ব্যস্ততা অথচ আমার যে মা জমজমাট ভরা সংসার করে জীবন কাটিয়েছেন তাঁর এখন আর কোনো ব্যস্ততা নেই। জীবনের এই অফুরন্ত অবসর সময় মানুষকে বিষণœ করে তোলে।

আম্মার কথা লিখতে গিয়ে একটা হাসির ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আমাদের ছেলে-মেয়েরা যখন ছোট তখনো মোটামোটি প্রতি বছরই বাংলাদেশে যেতাম। বাংলাদেশ ছিল তাদের ভীষণ আনন্দের জায়গা। নানানানি দাদা-দাদির আদর ভালোবাসা, কাজিনদের সাথে খেলা আড্ডা,আজ এক খালার বাড়িতে কাল আরেক খালার বাড়িতে দল বেঁধে থাকা, সব মিলিয়ে মহা-আনন্দের জায়গা ছিল ওদের বাংলাদেশ। ওদের রাতের বেলা আড্ডার প্রধান বিষয় ছিল ভ‚ত-জিন। বাংলাদেশে ভ‚ত-জিনদের চলা ফেরা আচার আচরণ, কোন গাছে ওদের বসবাস, কে কবে জিন ভ‚তকে দেখেছে জানালা দিয়ে ভেংচি কাটতে ইত্যাদি ঘটনা নিয়ে উদ্ভট গল্পগুজব চলতো ওদের। ওদের পরিচিত ভ‚তের নাম ছিল কুমকুম। অদেখা কুমকুম ভ‚তের গল্প ওদের শেষই হতো না। ভ‚তের ভয়ে সবগুলো গাদাগাদি করে এক ঘরে ঘুমাতো। কুমকুম ভ‚ত যদি কাউকে ধরতে আসে সবাই মিলে যেন কুমকুমের গলা চিপে ধরতে পারে।

বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার সময় কাজিনদের বিলাপ করে কান্না একটা দেখার বিষয় ছিল। সেবার আম্মাও এসেছিলেন আমাদের সাথে বিদেশি ছেলে-মেয়েদের বাড়িতে বেড়াতে। তখন আমার ছেলের বয়েস সাত বা আট হবে। আম্মাকে আমার ছেলের পাশের ঘরটি দেয়া হয়েছে থাকার জন্য। আম্মা আম্মার নিয়ম মাফিক রাতের বেলা ঘুমের মাঝে বিশাল শব্দ করে নাক ডাকা এবং কথাবার্তা শুরু করলেন। আমার ছেলের মাথায় তখনো কুমকুম ভ‚ত ঘোরাফেরা করছে। মাঝরাতে আমার ছেলে চিৎকার করে আমাদের ঘরে ঢুকে ডাকতে লাগলো, মাম্মি পাপা ওঠো, নানুকে কুমকুম ভ‚ত ধরেছে। আমরা ব্যাপারটা বুঝে গেলাম কি আসলে। সকালে এই গল্প শুনে আম্মা খুব লজ্জা পেয়েছিলেন।

আমার আম্মা একজন ভাগ্যবতী মা। যিনি ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে আছেন। আম্মা এখন হাঁটতে পারেন না। হুইল চেয়ার আম্মার চলা ফেরার মাধ্যম। অনেক কষ্ট হয় আম্মাকে দেখলে। তারপরও আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা, আরো অনেকদিন থাকুন আম্মা আমাদের মাঝে। প্রতিবারের মতো আম্মা যেন আমাকে বলতে পারেন, শিখু তোর নিজের একটা কবিতা পড়ে শোনা তো আমাকে?

আমার জীবনের সব চাইতে বড় সান্ত্বনা আমি আমার বাবা-মাকে কখনো কোনো কষ্ট দেইনি। মায়ের মুখে মুখে তর্ক করিনি। আর বাবার সাথে বেয়াদপি করার কোনো প্রশ্নই উঠেনি। আমি আমার বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান ছিলাম। সেটা যে শুধু আমার কথা তা না। আমার মাও তাই বলেন। আমার জীবনের সব চাইতে গুরুত্ব পূর্ণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও আমি বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে পারিনি।

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles