13.9 C
Toronto
রবিবার, মে ৪, ২০২৫

৬ মাস ধরে গোপন কক্ষে নারী-পুরুষকে বন্দি, জ্ঞান ফিরলেই দেওয়া হতো ইনজেকশন

৬ মাস ধরে গোপন কক্ষে নারী-পুরুষকে বন্দি, জ্ঞান ফিরলেই দেওয়া হতো ইনজেকশন - the Bengali Times
রহস্যময় কক্ষে বন্দী থাকা এক নারী ও এক বৃদ্ধ মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসার ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনারাম গ্রামে নির্মাণাধীন একটি ভবনের নিচে পাওয়া ‘আয়না ঘর’ নামের একটি রহস্যময় কক্ষে বন্দী থাকা এক নারী ও এক বৃদ্ধ মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসার ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় পাঁচ মাস ওই ঘরে আটকে থাকার পর শুক্রবার ভোররাতে শিল্পী খাতুন (৩৮) ও আব্দুল জুব্বার (৭৫) নামের ওই দুজন মুক্ত হন। তবে দীর্ঘ সময় বন্দী থাকার পরও তাঁদের শরীরে নির্যাতনের দৃশ্যমান কোনো চিহ্ন না থাকায় বিষয়টি ঘিরে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। এত দিন আগে এই ব্যক্তিরা অপহরণের শিকার হলেও তারা বেরিয়ে আসার পর এখন প্রশাসন তদন্ত শুরু করেছে।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি পল্লী চিকিৎসক নাজমুল হোসেন আরাফাতকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
অপহৃত ব্যক্তিদের একজন মো. আব্দুল জুব্বারকে গত ৮ নভেম্বর এবং শিল্পী খাতুনকে গত ১২ ডিসেম্বর অপহরণ করা হয়। ওই সময় রায়গঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা। এখন ভুক্তভোগীরা ফিরে আসার পর সেই থানায় অপহরণের দুটি মামলা করা হয়েছে।

- Advertisement -

পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় তারা তদন্ত শুরু করেছে। অভিযুক্ত অন্য ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সচেষ্ট রয়েছে পুলিশ। তবে ভুক্তভোগীরা নিখোঁজ হওয়ার পরে সাধারণ ডায়েরি করা হলেও কেন তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সে সময় তদন্ত করা হয়েছিল। এখন আবার তদন্ত শুরু করা হয়েছে।

চান্দাইকোনা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান খান বলছেন, গ্রামের ভেতরে যেভাবে ‘আন্ডার গ্রাউন্ড’ তৈরি করেছে তা কল্পনাতীত।

সম্পত্তির জন্য অপহরণের দাবি

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পূর্ব পাইকড়া গ্রামের ৮০ বছর বয়সী মো. আব্বুল জুব্বারকে গত বছরের ৮ নভেম্বর অপহরণ করা হয়েছিল। সেই সময় পরিবারের পক্ষ থেকে ঘটনার চার দিন পরে রায়গঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। তবে এই ছয় মাসেও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। গত শুক্রবার রাত প্রায় দেড়টায় তিনি মুক্ত হন।

অভিযুক্ত পল্লী চিকিৎসক নাজমুল হোসেন আরাফাতের বাড়ি পশ্চিম লক্ষীকোলা গ্রামে। এ গ্রামের বাজারে তিনি রোগীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে অপহরণের পর অন্য আরেকটি গ্রামে নিয়ে রাখা হয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। সোনারাম মধ্যপাড়া গ্রামের সুমন সেখের পাকা ভবনের ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে রাখা হয় জুব্বারকে।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, ভবনের মালিক মূলত সুমন সেখ। তার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ভবনের নিচের ফ্লোরে ছোট ছোট কক্ষ তৈরি করেন অভিযুক্ত পল্লী চিকিৎসক আরাফাত। তিনি ও তার কিছু লোকজন গভীর রাতে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন।

অপহৃত জুব্বারের নাতি মো. হাফিজুর রহমান ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, লক্ষ্মীখোলা বাজারে বিকেলে আরাফাত ডাক্তারের (অভিযুক্ত ব্যক্তি) কাছ থেকে ওষুধ আনতে যায় দাদা। পরে সন্ধ্যা পার হইয়া রাতেও বাড়ি ফেরে নাই। চাইর দিন খুঁইজা আমরা থানায় জিডি করছি। আমরা তারে (আরাফাত ডাক্তার) সন্দেহও করি নাই।

তিনি জানান, ভুক্তভোগী জুব্বার ফিরে আসার পর জানিয়েছেন পল্লী চিকিৎসক আরাফাত তাকে অপহরণ করেছেন। আটক থাকাকালীন তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘ফেরার পর দাদা বলছে বাজার থেকে আরাফাত ডাক্তারের মোটরসাইকেলে কইরা তারে নিয়া গেছে। তারে নির্যাতন করছে। চাকু দিয়া ডান পায়ের ঊরুতে জখম করছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় তারে মারছে।’

কেন বা কোন উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগী জুব্বারকে অপহরণ করা হয়েছিল, এমন প্রশ্নে হাফিজুর রহমান দাদার বরাত দিয়ে জানান, জায়গা-জমি, সব সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য তাকে অপহরণ করা হয়েছে। দলিলের মতো সাদা কাগজ নিয়া তারা মাইরা দাদারে বলতো জায়গা-জমি লিখে দিতে, স্বাক্ষর কইরা দিতে।

তবে তিনি জানান, অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে ভুক্তভোগীর জমিসংক্রান্ত কোনো পুরনো বিরোধ নেই।

কাঁচি দিয়ে খোঁড়া সুড়ঙ্গ দিয়ে মুক্তি

এক মাস পর আরেকজন অপহৃত শিল্পী খাতুনকে জুব্বারের ওই রুমে নিয়ে আসা হয়। এই ভুক্তভোগীর বাড়ি আবার অন্য গ্রামে। লক্ষ্মী বিষ্ণু প্রসাদ গ্রামের বাসিন্দা ভুক্তভোগী শিল্পী খাতুন। তিনিই মূলত ওই ভূগর্ভস্থ স্থান থেকে বের হওয়ার উপায় বের করেন।

মুক্ত হওয়ার পর ভুক্তভোগী নারী স্থানীয় জনগণের কাছে তাদের আটকে রাখার অভিযোগ করে বেশ কয়েকজনের নাম জানান। তিনি জানান, পল্লী চিকিৎসক আরাফাত, কামরুল, শরীফুল, হাফিজুল, পান্না, আছিয়া, মোমিন, মাসুদ, ফারুক এ কয়েকজনকে তিনি আটকাবস্থায় দেখেছেন।

তিনি বলেন, সুঁই দিয়া অজ্ঞান কইরা রাখছে। এক মাস কনে কনে (কোথায়, কোথায়) রাইখছে কইবার পারমু না। খালি অজ্ঞান হইরা হইরা (করে করে) রাখছে। যেই জ্ঞান ফিরছে কিছুক্ষণ ফরে আবার অজ্ঞান হরছে। এক মাস পর এই জায়গাত নিয়া আইছে। অজ্ঞান অবস্থার পরে দেখি আমার হাত বান্ধা, মুহে স্টেপ (স্কচটেপ) দেওয়া। পরে খুইলা দিছে। খুইলা দেওয়ার পরে ভাত খিলাই খিলাই (খাইয়ে খাইয়ে) আবার অজ্ঞান হরে। কী হরে না হরে আমি কিচ্ছু জানি না। এভাবে তিন-চার মাইস পরে কইছি বাবা আমাকে আর অজ্ঞান হরিছ না। তারপর আর করে নাই।

ভুক্তভোগী এই নারী জানান, তিনি যে কক্ষে ছিলেন সেখানে বয়স্ক একজন চাচাও তার সাথে ছিল। ওই ব্যক্তির শরীরে ঘা থাকার কারণে তা পরিষ্কার করতে একটি ছোট কেচি দেওয়া হয় তাকে। এই কেচির মাধ্যমেই চার দিন ধরে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে তারা ওই স্থান থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছেন।

তিনি বলেন, বুড়া চাচা আছিল আতে। হেই বুড়াডার পাঁছা সেক দিছিল। পাঁছাত ঘা হইছিল। পরিষ্কার করার জন্য একটা কেচি দেয়। তখন আমি চিন্তা করলাম এই কেচি আমার জান বাঁচাইব। আমি এই কেচি দিয়া চার দিন ভইরা মাটি খুঁইরা খুঁইরা…ছেড়া যখন ভাত দিবার যায়… তখন ওড়না মাথায় দিয়া এভাবে থাকি।

পাকা ভবনের একটি কক্ষের নিচের খুব সঙ্কীর্ণ কক্ষে তাদের রাখা হয়েছিল বলে জানান তিনি। জায়গাটা হইলো চাইর হাত লম্বা, তিন হাত ওষাড়….। ওই জায়গায় পেশাপ, পায়খানা সব কিছু। জানালার যে গ্রিল ওইটাই দরজা, তালা মারা থাকে। ওইটার তলে দিয়া ভাত দেয়। এইটা (কাঁচি) দিয়া চার দিন ভইরা খুঁড়ছি, বলেন তিনি।

ভুক্তভোগী জুব্বার বৃদ্ধ হওয়ায় নিজে একা মাটি খুঁড়েছেন শিল্পী খাতুন। আর জুব্বার খোঁড়া মাটি পাশে সরিয়ে রেখেছেন। যাতে সহজে পথ তৈরি হয়। তবে চারদিন মাটি খুঁড়ে গর্ত তৈরি করার পর কাঁটা ছড়ানো ছিল বলে দেখতে পান তারা। পরে সেগুলোকে সরাতেই সামনে অন্ধকার দেখে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসেন। অনেক দূর হেঁটে যাওয়ার পর গ্রামের একটি দোকানে তিন জন ব্যক্তিকে দেখতে পান তারা। তাদের কাছে মিথ্যা কথা ও বিপদে পড়ার কথা বলে মোবাইল ফোন চান।

তিনি বলেন, অনেক দূর গিয়া দেখি একটা দোকানে তিন জন মানুষ। মিছা কতা কইছি, বিপদ। পরে আমার বাড়িওলারে (স্বামী) ফোন দিছি, আইসা আমারে নিয়া গেছে। তবে তাকে ঠিক কী কারণে অপহরণ করা হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কিছু কয় নাই।

খালি কয় কিডনি বেইচা দিমু তোর। শুক্রবার দিবাগত রাতে ভুক্তভোগীরা মুক্ত হওয়ার পরই চিহ্নিত বাড়িটির সাথের একটি টিনের ঘরে শুক্রবার দিনে আগুন লাগিয়ে দেয় গ্রামের বিক্ষুব্ধ বাসিন্দারা।

পুলিশ কী বলছে?

এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুই ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় দুইটি অপহরণের মামলা করা হয়েছে। শনিবার মামলাগুলো করা হয়েছে। একটি মামলা করেছেন জুব্বারের ছেলে মো. শফিকুল ইসলাম। এ মামলায় অভিযুক্ত পল্লী চিকিৎসক, বাড়ির মালিকসহ ছয় জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও পাঁচ থেকে ছয় জনকে আসামি করা হয়েছে।

এছাড়া শিল্পী খাতুনের স্বামী মনসুর আলী বাদী হয়ে যে মামলা করেছেন তাতে ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। ওই দুই মামলায় অভিযুক্ত পল্লী চিকিৎসককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

রায়গঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান জানান, আজ রবিবার আসামির দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তবে ভুক্তভোগীরা অপহরণ হওয়ার পর করা জিডি অনুযায়ী পুলিশ কেন কিছু করতে পারেনি এমন প্রশ্ন এড়িয়ে তিনি জানান, সে সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করেছিল।

আয়নাঘর?

ভুক্তভোগীদের দাবি অনুযায়ী, যে ঘরে তাদের রাখা হয়েছে সে ঘরটি একতলা ইটের ভবনের নিচে অবস্থিত। এ ঘরটিকে এলাকার স্থানীয় মানুষ ‘আয়না ঘর’ এর সাথে তুলনা করছেন।

বাংলাদেশে গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম করা ব্যক্তিদের কিছু গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা হতো। এসব বন্দীশালাই আয়না ঘর নামে পরিচিত পায়। এসব ঘর খুবই সঙ্কীর্ণ এবং একজন ব্যক্তির বসবাসের অনুপযোগী। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর এরকম গোপন বন্দিশালাগুলোর সন্ধান মিলতে শুরু করে।

এসব বন্দিশালা থেকে মুক্ত হওয়া ব্যক্তিরা জানান, বছরের পর বছর কেউ কেউ পাঁচ বছর কেউ আবার আট বছর পর্যন্ত বন্দী ছিলেন এসব বন্দিশালায়। আবার কেউ কেউ নিখোঁজ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আর ফিরে আসেননি।

সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেন বলেন, নির্মাণাধীন ঘরের ভেতরে এটা। মাটির নিচে না। মাটির নিচে বলতে কী আসলে সমতল থেকে নিচের ঘর। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, এ ধরনের মিসিং আরো জিডি আছে কী না তা খুঁজে দেখছি আমরা। এ বিষয়ে আমরা আরো বেশি সোচ্চার হচ্ছি। যে এরকম কোনো ঘটনা থাকলে আমরা ইনভেস্টিগেট করে দেখবো।

চান্দাইকোনা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান খান জানান, তিনি ভুক্তভোগী আব্দুল জুব্বারকে খুব ভালোভাবে চেনেন। নিখোঁজ হওয়ার পর ছয় মাস আগে তার নেতৃত্বেই থানায় জিডি করা হয় বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, পেপার-পত্রিকায় দেওয়ার পরেও এত দিন কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। শেখ হাসিনা যে আয়নাঘর করছিলো সেটাও আমরা দেখছি। কিন্তু এই রকমভাবে একটা গ্রামের ভিতরে ভয়ানক আকারে শহরেও না এইরকম একটা আন্ডার গ্রাউন্ড তৈরি করছে এটা কল্পনাতীত। এই আন্ডার গ্রাউন্ডের যারা প্রতিষ্ঠাতা এই বাড়িসহ যারা আছে এরা প্রশ্রয়দাতা। আমি আরাফাতসহ সকলের ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি। জোরালো দাবি জানাই তার যেন ফাঁসি হয়। আইন যেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয় এই দাবি জানাচ্ছি।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles