2.1 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

স্বপ্ন বাতিঘরের মানুষ

স্বপ্ন বাতিঘরের মানুষ - the Bengali Times
ফাইল ছবি

বাতিঘর বললে ঠিক বোঝায় না। অনেক উঁচু টাওয়ারের মাথায় তীব্র শক্তিশালী বাতির ঝিলিক। সমুদ্রে আবছা কুয়াশায় জাহাজ দিকনির্ণয় করে। জীবনে প্রথম দেখেছিলাম চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ায়। পরে পৃথিবীর আরও অনেক দেশে। সুনীলদা হচ্ছেন তেমনি স্বপ্নের বাতিঘর। বাঙালি কত অগুনতি স্বপ্নবাজ তরুণকে স্বপ্ন দেখার দিক তিনি বাতলে দিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। হাজারো মানুষের কথা তো আমি বলতে পারবো না। তবে নিজের ব্যাপারে বলতে পারবো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সম্ভবত ব্লক আর লেটার প্রেসে ছাপা কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ পত্রিক আমার হাতে এলো। সম্ভবত কবি বন্ধু স্বপন দত্ত দিয়েছিল। অবাক হয়ে পৃষ্ঠাকে পৃষ্ঠা পড়েছিলাম। জীবনে সেই প্রথম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস পড়লাম। একবার শেষ করে আবার পড়লাম, বারবার তিনবার। জীবনে সেই প্রথম আমার ধারাবাহিক লেখাপড়া। আগের কিচ্ছু নেই, পরের কিচ্ছুও নেই; মাঝখানের একখন্ড লেখা কীভাবে এত পরিপূর্ণ! কীভাবে অন্যকে এভাবে টানে! আরও দু’একটি ‘দেশ’ যোগাড় করলাম, বন্ধু মিলন চৌধুরী একটি বই দিল সুনীলদার।
নতুন দেশ, নতুন স্বপ্ন। আমিও নতুন স্বপ্ন দেখছি। রাতদিন ড্রইং করি, ভীষণ ইচ্ছা ঢাকা গিয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হবো। এমন সময় খবর পেলাম ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে সাহিত্য সম্মেলন হতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করবেন। কলকাতা থেকে সুনীলদাসহ শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মনোজ বসু, আরো অনেকে আসছেন। আমি পাগল হয়ে উঠলাম, যেতেই হবে। বাবাকে টাকার কথা বলার সাহস নেই; মাকে পটিয়ে নিলাম সামান্য টাকা। সব ঠিকঠাক। ট্রেনের থার্ডক্লাসে করে ঢাকা যাবো। সুনীলদার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। বাধা এলো। প্রচন্ড জ¦রে পড়লাম। ঢাকা যাওয়া আর হলো না। তারা ফিরে গেলেন কলকাতায়। জানাতে হবে। একটা চিঠি লিখে ভাবলাম, উত্তর দিক আর না দিক ব্যাপারটা তো জানবেন। লিখলাম,

সুনীলদা, জীবনে স্কুল থেকে টেনে-হিঁচড়ে কখনো বড় কোনো প্রেসিডেন্ট অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর আগমনে রাস্তার পাশে আমাকে দাঁড় করাতে পারেনি। অথচ আমি কী পাগলের মতো, আপনার সামনে একবার দাঁড়াতে ঢাকা যেতে চেষ্টা করেছিলাম! এর পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখে ‘দেশ’ এর ঠিকানায় পোস্ট করে দিলাম। তারপর যথারীতি ভুলে গেলাম। মাত্র তেরো দিনের মাথায় দেখি দেশ পত্রিকার লোগো মুদ্রিত একটা ছোট খাম এলো। আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। খুলে দেখি মাত্র তিন-চার লাইন, ‘তোমার আগ্রহ আমি সম্মান করি। দেখা হবে কখনো-না-কখনো একদিন। আমার কোন ঈশ^র নেই, তাই তোমার সুস্থতার কামনা ইথারে ভাসিয়ে দিলাম’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

- Advertisement -

চিঠির শেষ লাইন। আমার তো কোনো ঈশ^র নেই, সুস্থতার কামনা ইথারে ভাসিয়ে দিলাম। এখনো হরদম আমার ভেতরে বুনো শক্তিশালী বাতাসের মতো ঘুরে বেড়ায়।

ঢাকায় এসে লিখছি, আঁকছি। সত্তর দশক শেষ হতে মাত্র হয়তো এক বছর বাকি। আমার প্রথম বই কিশোর উপন্যাস, চটি বই, শিশু একাডেমি থেকে বেরিয়ে গেছে। সন্ধানী পত্রিকার গাজী শাহাবুদ্দিন মনু ভাইদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠেছি তার ছোট ভাই গাজী নিজামউদ্দিন তনুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়াতে। জোনাকী সিনেমার পাশে গাজী ভবনে আবার এলেন সুনীলদা, দেশ সম্পাদক সাগরময় ঘোষ সস্ত্রীক। মনটা নেচে উঠলো, এবার দেখা হবে। দেখ হলো, উনাকে সেই প্রথম চিঠির কথা বলিনি। তবে দু’একবার অল্প কথা ছাড়া ধারে-কাছে যাওয়ার সুযোগ হলো না। ঢাকার লেখকরা তাদের গাদা-গাদা বই উপহার দিলেন। আমিও ‘কুশল আর মৃত্যুবুড়ো’ দিলাম। কিছু চটি ছোট-ছোট বই তারা সঙ্গে নিলেন। বাকিটা রেখে গেলেন সন্ধানী পত্রিকা অফিসে। আমার বইটা সঙ্গে গেলো শুধু চটির কারণে। কারণ যাই হোক ব্যাপরটা হলো বড়। সুনীলদা বইটি পড়েছিলেন; ভালো লেগেছিল। তখন তো আর সেলফোনের চল ছিল না। বন্ধু তনু বলল, মনুদা বলেছেন, আগামীকার দুপুর ৩টায় সুনীলদা সন্ধানী অফিসে ফোন করবেন। কথা হলো। সুনীলদার কাছে আপনজনের ছাড়পত্র পেয়ে গেলাম। বললেন, বইটা খুব ভালো লেগেছে। সবাইতো কাকা বাবু মামা বাবু নিয়ে আছে, তুমি এক্কেবারে কিশোরদের জন্যে জীবন আর মৃত্যুর সীমান্ত লাইনে দাঁড় করে দিয়েছ গল্প। কলকাতা এলে দেখা করো, আনন্দবাজারে এসো। আনন্দবাজারে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সব লেখক-কবির গুরুজন। কেউ কলকাতায় বিপদে পড়লে তাকেই ফোন করে আনন্দবাজার অফিসে গিয়ে হাজির হয়। আমার সম্পর্ক শুধু অফিসে সীমাবদ্ধ থাকল না। বালীগঞ্জে তার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ঠেকলাম। তার একমাত্র ছেলে পপলু তখন ছোট। ড্রইং রুমে তিনি শখ করে টেরাকোটা লাগিয়েছেন পশ্চিমের দেয়ালে। দেয়াল ঘেঁষে বড় সোফা, রাত-বিরাতে এই সোফাই আমার বেড হতো। এই সময়ে আমি আমার স্বপ্নের বাতিঘরকে কাছে থেকে দেখলাম। ভোর পর্যন্ত লিখছেন অথচ চোখেমুখে কোনো ক্লান্তি নেই। রাতে ফ্রিজ খুলে মিষ্টি খাওয়ার শখ আমার, তাঁরও। মাঝেমধ্যে ভোর ৪টায় উঠে ফ্রিজ খুলে দেখেন রাবড়ীর কৌটা খালি কিংবা মোহনভোগের বাক্সে একটিও মিষ্টি নেই। আমি নিজেই অবাক হতাম, কী করে এতো মিষ্টি গিলে ফেলতাম তখন!

বাতিঘর দিশা দেখায়। স্বপ্ন বাতিঘরের মানুষরা পকেটে এক গাদা চুম্বন ভরে দিয়ে বলে, যা, দিক বেদিক উড়িয়ে দিয়ে আয়!
এক রাতে হুইস্কি নিয়ে আমার সামনে বসলেন; জিজ্ঞেস করলেন, খাবে?
অবশ্যই।

সে রাতে তার উপন্যাসে নারী চরিত্র নির্মাণের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম।
বিয়ের পরপর তোমার বৌদি মনে করত, উপন্যাসের সব নারী চরিত্র আমার চেনা-জানা। আমি হাসতাম। হাসি দেখে সে আরও রেগে বলত, হাসছো কেন?
খুশি হয়েছি বলে হাসছি। চরিত্রগুলো এতো জীবন্ত হয়েছে যে, তুমিও ভুল করছ।
হুইস্কি শেষ করে আবার লিখতে উনার রুমে ঢোকার আগে বললেন

একটা জিনিস মনে রেখো, সত্যিকার ক্রিয়েটিভ পুরুষ শুধু নারীর এক ধরনের শেড দেখে শান্ত হয় না। পিকাসোর ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি ছিল বলে উনি সবকিছু খুল্লাম-খুল্লাম করে গেছেন। চুনোপুঁটিরা এই আগ্রহ আড়াল করতে করতে জীবনের অর্ধেক সময় অপচয় করে। সুনীলদার, সঙ্গে সেই কাছে আসা, তা সারাজীবন ছিল। কী আমেরিকায়, কী কানাডায়, যেখানেই গেছেন আমি আছি জেনে খোঁজ নিয়ে ডেকেছেন। বিশেষ করে কানাডার টরন্টোতে আমি দশটা বছর থিতু হয়েছিলাম। যতবার তিনি গেছেন, ওনার সঙ্গে আনন্দে কেটেছে। কাছে থেকে যত দেখি ততই অচেনা লাগে আমার প্রিয় ড্রিম মার্চেন্টকে। টরন্টো গেলে তিনি উঠতেন অশোক চক্রবর্তী আর ভারতী চক্রবর্তীর রোজডেলে দামি বাড়িতে। অশোকদাও কবিতা লেখেন। দেশ পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে তার কবিতা। ভারতীয়দের অনুরোধে তিনি যেখানে গেছেন, যা করেছে সব ছবি প্রিন্ট করে অ্যালবাম করে তাকে উপহার দিতেন। যথারীতি অ্যালবামটির প্রচ্ছদ আমাকে এঁকে দিতে হতো। বাস্তব আর স্বপ্নকে মিশ্রিত করে যেসব কালপুরুষ একের পর এক সৃষ্টি করেন শত চরিত্র, তাদের বাস্তবেও গুণমুগ্ধতার অভাব নেই। সেটাই স্বাভাবিক। সুনীলদার সূত্রেই আসি আমার দেশের অন্যকে আলো দেখানো বাতিঘর ব্যক্তিত্বের কথায়। যিনি আমাকে শিখিয়েছেন প্রথম থেকে স্বপ্নকে কীভাবে তাড়া করতে হয়। বয়সে পিছিয়ে থেকেও তার সঙ্গে আমার শ্রদ্ধামিশ্রিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি আমার কাছে গুরুদেবের মতো। আমার কাছে সবসময় মনে হতো সুনীলদা আর রাহাত খান একইভাবে অন্যের মধ্যে স্বপ্নের বীজ ঢুকিয়ে দেন। ক্ষমতায় দু’জনই সমানে-সমান। আজও আমার কিশোরদের জন্য লেখার প্রেরণা অটুট আছে, যেহেতু চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রথম এবং পরপর অনেকবার রাহাত ভাইয়ের ‘দীলুর গল্প’ পড়েছিলাম বলেই। কিশোরকালের শেষদিকে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে পড়ে মহাসাগরে জাহাজের খালাসী হতে পাগল হয়ে উঠেছিলাম। চট্টগ্রাম বন্দরে এক হল্যান্ডের জাহাজের অফিসার বলল, ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট থাকলে সে চেষ্টা করতে পারে। ঢাকায় নির্মলেন্দু গুণ সঙ্গে নিয়ে আলাপ করিয়ে দিলেন রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে। পরে রাহাত খান একদিন সময় করে নিয়ে গেলেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের কাছে। তিনি নিয়ে গেলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর দপ্তর সচিবালয়ে। পাসপোর্ট হলো কিন্তু ততদিনে সাগরে ভাসার চেয়ে ঢাকার উত্তাল সাহিত্য জগতে ভাসার মজা পেয়ে গিয়েছিলাম। ব্যারিস্টার সাহেবের মেমরি ভীষণ ভালো। এখনো মুখোমুখি হলে ডাক দিয়ে বলেন, এই ছেলে! তুমি সাগরে ভাসতে পাসপোর্টের জন্য আমার কাছে এসেছিলে! কী হলো?

কোনোভাবে এড়িয়ে গিয়েছি এতদিন। এবার ভাবছি বলবো, স্যার, মাফ করে দেন। হলো না আর সাগরে ভাসা, দেখতে দেখতে আকাশে ভাসার সময় হয়ে গেছে। দূর! কী সব সাগর, জাহাজের কথা বলছি। বলতে যাচ্ছিলাম গুরুদেব রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা। স্বপ্নের সঙ্গে ভীষণ যোগাযোগ সিনেমার। সিনেমার মধ্যে স্বপ্নের সঙ্গে ভীষণ যোগাযোগ সিনেমার। সিনেমার মধ্যে স্বপ্নের বসবাস। আশির দশকের এক্কেবারে প্রথমদিকে কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সাপ্তাহিক রোববারের প্রতিনিধি হয়ে গেলাম। অপর্ণা সেনের কিংবা গৌতম ঘোষের প্রথম ছবির চেয়ে আমার কাছে আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশের সিনেমা, যেটি ইতোমধ্যে ইউরোপসহ অনেক জায়গায় নাম করেছে, বাংলাদেশের সিনেমাটি যাচ্ছে। সঙ্গে পরিচালকও যাচ্ছেন। তিনি আমার খুবই পরিচিত। কলকাতা গিয়ে সুনীলদার অফিসে দেখা করতে গিয়ে পরিচিত হলাম তার এই মুগ্ধাবতীর সঙ্গে। দিদি সম্বোধন করলাম। পাঁট ফুট দশ উচ্চতার ফর্সা একটু চাবি-চাবি দেখতে; চোখ-মুখ-চুল সবই প্রতীমার মতো। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ জানা। সঙ্গে ছোট্ট আদরের পাপি ডগ, সব মিলিয়ে আধুনিক মা দুর্গা। স্বামী বিখ্যাত সিনেমা সমালোচক, সাংবাদিক। সেই সময়টায় সম্ভবত সেপারেট থাকেন দু’জন। পরে তিনি বাংলাদেশের সিনেমার জন্য মিডিয়া ব্রিফিং, প্রেস কনফারেন্স করানো ছাড়াও অনেক হেল্প করে গেলেন। সতেরো দিনের মধ্যে আট দিন মাত্র পরিচালকের হোটেলে থাকার পারমিশন ছিল। তার সিনেমা দেখানো হয়ে গেলে, ওনাকে অন্যত্র থাকতে হবে। দিদি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কমিটির সঙ্গে অনেক তর্কাতর্কির পর ফুল সতেরো দিন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরিচালকের সঙ্গে প্রায় আমি থাকতাম, তাই আমার সঙ্গেও দেখা হতো। পরিচালকের সঙ্গে আমাকেও খাওয়াতে হতো। কলকাতায় বাংলাদেশের সিনেমাটির বেশ কাভারেজ হলো, সুনাম কুড়ালো। প্রায়ই দেখতাম, পরিচালক ও দিদি ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছেন। অবশ্য ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পার্টিগুলোতে আমিও থাকতাম, দেখা হতো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় বার স্বাতী বৌদি এবং দেশ পত্রিকা স¤পাদক স্বস্ত্রীক সাগরময় ঘোষ এসেছিলেন ঢাকায় মনু ভাই সচিত্র সন্ধানী পত্রিকা সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দীনের বাড়ি ‘গাজী ভবনে’। সোফার পেছন দিকে আমার পাশে লেখক মাহমুদুল হক কবি রফিক আজাদ। সময় কাল ১৯৭৪

ফেস্টিভ্যাল শেষ, ঢাকা ফিরে ধারাবাহিক লিখলাম ‘রোববার’ পত্রিকায়। তখন আমি বিটপী অ্যাডভার্টাইজিংয়ে কাজ করি, ৩৫ তোপখানা রোডে অফিস। এক কাজ শেষে মতিঝিল বিমান অফিসের সামনে দিয়ে অফিস ফিরছি। দেখি সেই দিদি ফুটপাত দিয়ে হনহন করে হেঁটে সম্ভবত বিমান অফিসের দিকেই যাচ্ছেন। রিকশা ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম।
এ্যাই! কে তুমি!

আমি ইকবাল। চিনলেন না? কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এতবার দেখা হলো। সুনীলদা তার অফিসে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন।
ওহ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। চিনলাম। কী করছো এখানে এই বজ্জাত জায়গায়?
মানে, কী বলছেন আপনি? এটা আমার দেশ।
তোমার দেশের মানুষের এতো পাজি, বজ্জাত কেন?
ধ্যাৎ, কী হয়েছে বলেন দিদি। সবাইকে একসাথে বোম মেরে দিয়েন না।
এই পূর্বাণী হোটেলে এসে উঠেছি এক রাত দু’দিন হতে

যাচ্ছে। সেই পরিচালককে ফোন করেছিলাম। একবার এসে দেখা করে গেছে। তারপর উধাও। বাসার ঠিকানা ছিল, বেবিট্যাক্সি নিয়ে খুঁজে খুঁজে বাসায় গিয়ে দেখি তালা দিয়ে গায়েব। যাচ্ছি বিমান অফিসে, ফিরে যাওয়ার টিকিট কনফার্ম করি। হোটেল চার্জেও অনেক টাকা ফুরিয়ে আসছে।
আমি বুঝলাম। মহিলা পাগল আছেন, হুট করে এসে নাজিল হয়ে পরিচালককে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজ। পরিচালক ঘর-সংসার-বউ নিয়ে আচমকা এই চমক নেয়ার চেয়ে আড়ালে ডুবে থাকাই শ্রেয় ভেবেছেন। তবে আমার কাছে এখন দেশের ইজ্জত। এই ধারণা নিয়ে ফিরে গেলে তো কলকাতায় গিয়ে সবাইকে বলে ভরিয়ে ফেলবে, বাংলাদেশের কথা আর বলিস না! দিদি শান্ত হোন। চলেন আপাতত হোটেলের লবিতে গিয়ে বসি। সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে মাত্র আধ ঘণ্টা সময় দেন।

তিনি লবিতে সোফায় বসে হাঁফ ছাড়ালেন। দুটো কফি অর্ডার করে রিসেপশন ডেস্কের পাশে পে ফোন থেকে রাহাত ভাইকে ফোন করলাম। সব শুনে রাহাত ভাই বললেন, ‘ইত্তেফাকে প্রথমবার না, পরে নিয়ে যাব। আধ ঘণ্টার মধ্যে তুমি মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে আমার বন্ধুর অফিসে নিয়ে এসো। আমি আজ ওই অফিসেই যাচ্ছিলাম। আমি পৌঁছে পূর্বাণীতে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি রাহাত ভাই যে কত বড় লেখক-সাংবাদিক বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। উদাহরণস্বরূপ বারবার সুনীলদা আর আনন্দবাজারের কথা বলছিলাম। এই যেমন, ইত্তেফাক আনন্দাবাজারের মতোই প্রাচীন নামি ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা। তিনি যেমন সাংবাদিক, তেমনি জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। অনেকটা সুনীলদার মতো আর কি!

তিনি তো দিদি, এক আজিব রাগী মহিলা। পথে ঠিক চুপ করে শুনলেন। ঠিক রাহাত ভাইয়ের ও তার বন্ধুর অতীব সুন্দর মেহগনি কাঠে আগাগোড়া মোড়ানো অফিসে তোশিবা এসির ঠান্ডায় ফায়ার হয়ে উঠলেন।
তুমি আবার সুনীলের কথা বলছ কেন? যার সঙ্গে আলাপ করাতে আনলে উনি লেখক-সাংবাদিক বুঝলাম। তবে ওই আনন্দবাজার, ঐতিহ্য এসব নিয়ে বলতে এসো না।

রাহাত ভাই ম্যানেজ করলেন। সরি, আমি রাহাত খান ও আমার বন্ধু রাশিদুল আমিন পোদ্দার, দেশের নামি শিল্পপতি। আর ওই ছোট ভাইটির জন্য আমি সরি. বয়স হচ্ছে, অথচ ওর ভেতর থেকে অবুঝ, সরল কিশোরকে তাড়াতে সে পারছে না।

এই প্রথম দিদি হাসলেন। আকাশি রঙের সাফারি স্যুট পরেছিলেন রাহাত ভাই, দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে ওনার একটা দৃঢ়তা থাকে, আমি দেখি, ফলো করতে চাই কিন্তু সামান্যটুকুও পারি না। মনে মনে ভাবছিলাম, দিদির এই বাংলাদেশের সবার ওপর রাগ কমুক। ঢাকায় কত কিছু দেখার আছে, খাওয়ার আছে, যাওয়ার আছে। দেখুক, জানুক, অন্তত ফিরে গিয়ে দেশের মানুষের বদনাম না করুক।
এরপর আরও তিন দিন দিদি ঢাকায় ছিলেন। প্রতিদিন কোনো কোনো জায়গায় রাহাত ভাই দেখাতে নিয়ে গেছেন। যেমন সোনারগাঁর পানাম দেখে তো দিনি অবাক। সুনীলদা হয়তো ফোন করেছিলেন। যাওয়ার দিন কবি বেলাল চৌধুরী নিতে এলেন সঙ্গে আবার আয়ান রশীদ। আয়ান রশীদ সিঙ্গাপুর থেকে কলকাতা ফেরার পথে নয় ঘণ্টার স্টপ নিয়ে দিদির সঙ্গে একই ফ্লাইটে ফিরে যাবেন। তার আগে সবাই মিলে তারা ভালো কোথাও ডিনার করবেন। আমাকেও সঙ্গে থাকতে বললেন, আমি বুঝিয়ে কাট্টি মারলাম। এই সব বিশাল মাপের মানুষদের সঙ্গে বসে ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারব না। দিদি খুব খুশি, এত গিফট পেয়েছে যে সুটকেসে ঠাঁই হয় না। বারবার বলছেন- রাহাত, বেলাল, আমার ঢাকা তো আপন মনে হচ্ছে। আসামাত্র বেলালকে যোগাযোগ করতে পারিনি, ফোন নম্বর হারিয়ে ফেলেছিলাম। একবারও আমার কথা বললেন না। বলার কোনো মানেও হয় না।

যাই হোক, আবার সুনীলদার কথায় ফেরা যাক। সুনীলদার সঙ্গে শেষবার টরন্টোতেই দেখা হলো। টরন্টোর প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ‘দেশে-বিদেশে’ ওনাকে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। সম্পাদক নজরুল ইসলাম মিন্টু অনুষ্ঠানের ব্যাকগ্রাউন্ড দেয়ালের জন্য বিশাল ডিজিটাল ব্যানার প্রিন্ট করতে চাইছিলেন। আমি বললাম, শুধু সাদা ক্যানভাস লাগিয়ে দেন। নিজের হাতে রঙ দিয়ে সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ওনার বিশাল পোর্টেট এঁকে দেবো। ঢুকেই ছবিটি দেখে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। বললেন, ইকবালের কান্ড!

আমি আমার মেয়ে অগ্নিলাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে দেশেও দেশের বাইরে সারাজীবন ইংরেজি মিডিয়ামে পড়লেও ভালো বাংলা পড়তে পারে, লিখতে পারে। সুনীলদার একটা বই তার খুব প্রিয়, সম্ভবত প্রথম আলোর প্রথম খন্ড। সে বইটা হাতে করেই সই করাতে নিয়ে গিয়েছিল। মেয়ের মাথায় হাত রেখে সুনীলদা বলেছিলেন, ইকবাল তুমি ভাগ্যবান, আমি খুব করে মেয়ে চেয়েছিলাম।

পরে খাওয়ার পর টিম হর্টনের কফি খেতে খেতে আলতো করে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ইকবাল আমাদের মতো মানুষের স্বপ্ন দেখার ব্যাটারি হরহামেশাই ডাউন হয়ে যায়। তখন খুঁজে নিতে হয় কার কাছে চার্জার আছে। মায়ের কাছে থাকতে পারে, মেয়ের কাছেও, বউয়ের কাছে আবার প্রেমিকার কাছে এমনকি বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বৌদি। তাদেরকে আমাদেরই খুঁজে নিতে হয়, স্বপ্নের মেশিন তো আর বন্ধ রাখা যায় না।

স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles