8.4 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

ইফতার সমাচার

ইফতার সমাচার - the Bengali Times
ফাইল ছবি

ইফতারের দাওয়াতে গেলাম টরন্টো’র ফাইভ মেসি স্কয়ার বিল্ডিং এ। আমার বন্ধুর এক শুভাকাঙ্খী ক্লায়েন্টের বাসায়। সুন্দর বাসা কিনেছে, ঝকঝকে রেনোভেট করা এপার্টমেন্ট। আমি ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে চিশতীর পাশে বসতেই সে আমার দিকে সামান্য ঝুকে, ভুঁরু নাচিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, কী বুঝলি?
– বাসা তো দারুন!
– আরে বেকুব, আমি জানতে চাচ্ছি আইটেম কী কী?
– ঘুগনি, পিঁয়াজু, বেগুনি, খেজুর, মুড়ি, আপেল, কমলা, জিলাপি, হালিম
– বাহ্! ডিনারে?
– খাসির তেহারি, টিকিয়া
– বুঝলি কেমনে খাসির?
– গন্ধে
– পারফেক্ট!- বলে তাহেরী হুজুরের মতো কনুই দিয়ে আমাকে হালকা গুঁতো দেবার ঢঙ্গি ভঙ্গিতে একটা গালি দিতে গিয়েও চেপে গেলো; হয়তো রমজান মাস বলে।

ইফতার শেষ করে আমরা জামাতে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি নামাজ শেষ করে বাইরের ঘরে গিয়ে বসি। চিশতীর সাথে তাল মেলানোর মতো ধৈর্য আমার নাই। সে শুধু সুন্নতই পড়বে না; সাথে ওয়াজিব, নফল সব। ব্যাপারটা অবশ্য ভালো, সোয়াব বেশি। তারপর পাক্কা দশ মিনিট ধরে দুই হাত তুলে, কেঁপে কেঁপে শরীর ঝাকিয়ে চোখের পানি ফেলবে। তার এতো কিসের কষ্ট খোদা জানে!

- Advertisement -

সে মিনিট বিশেক পরে নামাজ শেষ করে আমাকে ডাক দিয়ে বেলকুনিতে নিয়ে গেলো। বিড়ি ধরিয়ে মনের সুখে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। রোজা রাখার পর বাদ মাগরিব হলো বিড়িখোরদের সবচাইতে আকাঙ্খিত ক্ষণ। রোজার দিনে খিদের চাইতে এদের বড় কষ্ট বিড়ি না টানতে পারা। সে ভুশ করে এক গাদা ধোঁয়া ছুড়ে নিচু গলায় বলল, তোর এইটুক ধৈর্য নাই? দুই মিনিটে সুন্নত পড়ে দৌড় মারলি? তেহারি কি পালায়ে যাচ্ছে?

সে আঙুলের ফাঁকে বিড়ি ধরা অবস্থায় নিপুণভাবে স্মার্টফোনে ফেইসবুকের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল- আমার মাথায় ঢোকে না, লেখক-লেখিকারা কেন মুগ্ধ হয়ে নিজের লেখা বই পড়ার ছবি পোস্ট করে? লেখকের বই পড়বে অন্যরা..
– প্রুফ রিডিং করে দোস্ত; ভুল ভ্রান্তি খুঁজে দেখে, নেক্সট ভার্সনে ঠিক করবে
– তাই বল..

তার এসব মিনিংলেস কথা শুনলে ভয় লাগে। তার প্রতিটা স্টেপ আমার মুখস্ত। ঝড়ের আগে যেমন বাতাস খুব হালকা থাকে, শান্ত থাকে; তার অভ্যাস হলো জটিল কিছু শুরু করার আগে পরিবেশ হালকা করে নেওয়া। তারপর দিবে বাঁশ! সে আবার ধোঁয়া ছেড়ে বলল- একটা বিপদে পড়লাম; হেল্প করতে পারবি?
– অবশ্যই!
– তেমন কিছু না, রাকিব ভাইয়ের বড় মেয়েটার সাথে একজনের সম্পর্ক ছিল। পরে দেখা যায় ছেলে গাঁজাখোর, ফেন্টনিলও নেয়। আজ ইফতারের পর নাকি সে তার বন্ধুদের নিয়ে আসবে প্রস্তাব দিতে। খুব ডেয়ারিং!
– মেয়ে রাজি না?
– না। সমস্যা হলো মেয়ের বাপ কৃপণ হলেও অনেক সম্পত্তির মালিক। ছেলের নজর সম্পত্তিতে। তা না হলে মেয়ে বিয়ে করতে না চাইলে তো পুরুষ মাইনষের আরও খুশি হওয়ার কথা। তোর হেল্প দরকার- বলে দফায় দফায় রেলগাড়ির স্টিম ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। টেনশনে সে গ্রিন হাউজ ইফেক্ট অনেক বাড়িয়ে দেয়।

আমি আগেই একটা আশংঙ্কা করেছিলাম। ইফতারিতে যখন সে বারবার আমার বাটিতে হালিমের গামলা থেকে মাংস বেছে তুলে দিচ্ছিল, এক গাদা মচমচে বেগুনি তুলে দিচ্ছিল প্লেটে; তখনই আমার মনে সন্দেহের দানা বেঁধে উঠেছিল; ডাল মে কুছ কালা হেয়! কারণ ছাড়া সে কখনোই আমাকে জামাই আদর করে না। ন্যাড়া নাকি বেল তলায় একবার যায়, আর আমি ন্যাড়া হয়েও বেলতলা, তালতলা, নারকেলতলা; সব তলায় ঘুরঘুর করি। গতবার সে আমাকে এক বাড়ির মিলাদে নিয়ে গিয়ে বেইজমেন্টে একটা টুল এগিয়ে দিয়ে এক ঝুড়ি জিলাপি, লাড্ডু, দুই ঝুড়ি শিঙাড়ার সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল-“এই নে, স্টেপলার আর ঠোঙা। তিন পিস করে জিলাপি, একটা করে লাড্ডু, একটা করে সিঙ্গারা ভরবি”। পরে বুঝলাম; সে কেন মিলাদে দুই ঘন্টা আগে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি আসলেই বোকা। শেষে সিন্নি কম পড়ছিল, আমরা অনেকে একটা জিলাপি পর্যন্ত পাইনি।
দুনিয়ায় অনেক মতলববাজ দেখছি, আমার বন্ধুর মতো দুইটা দেখি নাই।

সে বলতে থাকলো- ছেলে প্রচন্ড জেদি। মেয়ে অনেক আগেই বলে দিয়েছিল যে বিয়ে করবে না। এও জানিয়েছিল তার আরেকজনের সাথে এনগেজমেন্ট হয়ে আছে। ছেলে বিশ্বাস করেনি। এখন আজ রাতে যদি সত্যি সত্যি চলে আসে, তখন মেয়ে ধরা খাবে। ছেলে নাকি মেয়ের সাথে সরাসরি মুখোমুখি কথা না বলে যাবে না। তাদের দেখাতে হবে আজকে বাদ মাগরিব হঠাৎ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে থাকে আমেরিকা, কাল সকালের ফ্লাইটে বৌ নিয়ে ফিরে যাবে। তোকে বর সেজে প্রক্সি দিতে হবে
– আমি পারবো না, তুই সাজ
– উল্লুকের মতো কথা বলিস কেন?- বলে সে খেপে গিয়ে চেয়ার উল্টে পড়তে পড়তে কোনরকমে ব্যালেন্স সামলিয়ে, অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর মুখ খুলল- মেয়ে লম্বা কত জানিস? আমার সাথে মানাবে? তাছাড়া এইটুক উপকার করবি না? একটা মেয়ের জীবন মরণ সমস্যা। মেয়ে বলেছে এই ছেলের সাথে বিয়ে হলে সুইসাইড করবে। মরলে কিন্তু তুই দায়ী থাকবি!
– যদি চিনে ফেলে?
– মাস্ক পরে থাকবি, আর মাথায় টোপর থাকলে তোর টাক ঢেকে যাবে।

জেলের ভাত খাবার ভয়ে রাজি হয়েই গেলাম। ব্র্যান্ড নিউ শেরওয়ানী; এটা নিশ্চয়ই আগে থেকে কিনে রাখা? প্রি প্ল্যানড! ইচ্ছে করলেই পালানো যায়, কিন্তু একটা মেয়ের জীবন বলে কথা। চিশতী অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে ছিটকিনি আটকিয়ে আমাকে সাজাতে থাকে। বলল, জ্যাকেট খোল
– খুলতেছে না দোস্ত, চেইন আটকায়ে গেছে।
শেষ রক্ষা হলো না; সে অনেক ঝুলাঝুলি করে আমার বুকের কাছটার চেইন ছিঁড়ে ফেলে বলল, ব্যাপার না। কিনে দিবো। রিপন
– হু
– মেয়ে মাশাল্লাহ খুব সুন্দর। শেষ বিয়ে যেন কবে করছিস?
– দুই হাজার ছয়-এ
– আমি বিয়ে করছি সেই দুই হাজার চার-এ। তোকে রাজপুত্রের মতো লাগতেছে!
– ধ্যাৎ, তুই একটা যা তা..
– মনে রাখবি, ছেলে কিন্তু তোকে দেখে শিওর হতে চাইবে যে তুই আসলেই উর্মিকে বিয়ে করছিস, কি না। তোর ডাক পড়লে মেয়ের গা ঘেঁষে বসবি। মেয়েকে তুমি তুমি, আর তার মা বাপকে আম্মা-আব্বা ডাকবি। উল্টা পাল্টা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিবি না, যা বলার আমি বলবো
– ওকে
– সব সময় নিজেকে ডিফেন্স করবি, প্রয়োজনে অফেন্সিভ হতে হবে
– মানে!
– মনে রাখবি, মার খাওয়ার আগেই মেরে দিতে হয়। বুঝতে হবে কখন তোকে পাঞ্চ করতে হবে; উইল স্মিথের মতো!
– কি সর্বনাশ! ক্যামনে!
– বডি লেঙ্গুয়েজ দেখে, চোখের ভাষা পড়ে। বাঘ, ভাল্লুক, হাতি, গরু, কুকুর এদের চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় কী করতে যাচ্ছে। মানুষের চোখের ভাষাও বুঝতে হবে। ছেলে যদি মাটির দিকে তাকায়ে কথা বলে, বুঝবি কিছু করবে না; ভেজা বেড়াল। যদি দেখিস চোখে চোখ রেখে কথা বলছে, হাত সোফার হাতলের উপর, তখনও তেমন আশংকার কিছু নাই। মেক্সিমাম খারাপ কিছু কটু কথা শোনাবে হয়তো। যদি দেখিস দুই হাত বুকের কাছে বাঁধা, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, বুঝবি প্রস্তুতি নিচ্ছে একটা অঘটন ঘটানোর জন্য। কিন্তু যদি দেখিস ছেলে ছাদের দিকে তাকায়ে ঘন ঘন অক্সিজেন নিচ্ছে, দেরি না করে দিবি বসিয়ে নাক বরাবর!
– দোস্ত, মাইরটা না হয় তুই দিস?
– এই বোকা, আমার হাতে মার খাওয়া আর সতীনের হাতে মার খাওয়া এক? সতীনের হাতে মার খেলে দারুন ইফেক্টিভ হবে, ইজ্জত বলে কিছু আর থাকবে না। মনে রাখিস, মেয়ের কিন্তু কিছুটা মায়া এখনো ঐ ছেলের উপর আছে। সাবেক প্রেমিক বলে কথা! বেশি মারিস না যেন..
– দোস্ত, শেরওয়ানী যে খুব টাইট?
– খা, আরো বেশি করে খা..

ছেলে সত্যি সত্যি চলে আসলো দুই বন্ধু সাথে করে। আমাকে ডাকলে যাবো; প্রয়োজনে। বাইরের ঘরে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতে থাকে। মেয়ের খালা দরজা নক করে বলল, একটু আসেন ভাই, আপনাকে দেখতে চাচ্ছে।
আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো, চিশতী বাসায় নাই? ব্যাটা পালিয়েছে তাহলে!

আমি নাগরা পরে লিভিং রুমে গিয়ে দাঁড়াতেই পেটের চাপে শেরওয়ানির বোতাম ফটাশ করে ছিঁড়ে কোনদিক যেন হারিয়ে গেলো। ইনক্রেডিবল হাল্কের মতো! তিন জনের এক জনকে দেখি সত্যি সত্যি ছাদের দিকে তাকিয়ে হাঁপাচ্ছে! আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বিসমিল্লাহ বলে দিলাম বসিয়ে নাক বরাবর!

তারপর কী হলো আমার আর তেমন মনে নাই।
আমি দৌড়ে নিচে নেমে এসে গাড়িতে উঠে সোজা অটোয়ার দিকে রওনা দেই। সাড়ে চারশো কিলোমিটার পথ এক টানে একশো চল্লিশ কিলোমিটার বেগে চালিয়ে, সাড়ে তিন ঘন্টায় বাসায় পৌঁছে কলিংবেল চাপি। বৌ দরজা খুলে হতবিহ্ববল চোখে আমার আপদমস্তক চেয়ে দেখলো মিনিটখানেক ধরে। তারপর তার দুই ঠোঁট কাপাকাপি শুরু হয়ে গেলো; ছলো ছলো চোখে কিছু একটা বলতে চাইলো, কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বেরোলো না। দরজাটা আমার নাক বরাবর ধ্রিম করে বন্ধ করে, মুখে ওড়না চেপে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে ছুটলো ভেতরে।

আমি চিশতীর ভয়েজ মেসেজ শুনতে থাকি: এই রিপন, তুই কোথায়? শেরওয়ানি ফেরত না দিয়েই চলে গেছিস? আর তুই কারে ঘুষি মারছিস? হাঁপানি রুগীরে মাইরে চিৎ করে ফেলে আসলি? জীবন নিয়ে টানাটানি..
সবকিছুই আমার কাছে যেন ঘটে যাওয়া গোলমেলে এক দুঃস্বপ্ন!

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles