8.1 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

হৃদয়ে সাবলেট হবে

হৃদয়ে সাবলেট হবে
ছবি রিচার্ড বেল

ইচ্ছা করে কিন্তু পারি না। শেয়ার করতে পারাও একটা গুণ যদি ভাবি তাহলে সাবলেট শব্দটি নেংটি পরে সামনে লাফিয়ে পড়ে। সাবলেট এই শেয়ার করা জীবন্ত মানুষরা হাজার রকম করতে পারেন, মন শেয়ার করা, স্বপ্ন শেয়ার করা, এমনকি শরীর শেয়ার করা সবাই সাবলেট। তবে দুর্ভাগ্যবশত আমাদের বাঙালি জীবনে অন্যসব সাবলেট ধোঁয়াশা আলো আঁধারীতে লুক্কায়িত স্পষ্ট শুধু পাড়া, গলির দেয়ালে, পত্রিকার পাতায় পাতায় রুম সাবলেট দেওয়া হবে কিংবা চাই।

আমার কিন্তু এই শেয়ার গুণটি একেবারে নেই, ইচ্ছাও করে না। নিজের মধ্যে নিজের ভাঙন-গড়ন! নিজের মধ্যে নিজের স্বপ্ন পূরণ নিয়ে থাকি। অনেকে বলতে পারেন আজ-কাল তো ফেসবুক সবাই শেয়ার করে। আপনিও বাদ যান না। আসলে আমি শেয়ার করি না ঘটনার বিবরণ সবাইকে অবগত করি। জানাই আমার এই দিন এ রকম ঘটল। এর মধ্যে কোনো শেয়ারিং ব্যাপার-স্যাপার নেই।

- Advertisement -

সাবলেট মানে যখন থাকার ব্যাপারই সবাই ভাবে তখন অন্য কোনো আধ্যাত্মিক সাবলেটের বাসা না বলে এই থাকার ব্যাপারে বলি। পৃথিবীর সব মেগাসিটিতে এ ব্যাপারটা রমরমা। তবে অন্যান্য মহাদেশের নামি শহরে সাবলেটের ব্যাপারে একটা অবাধ স্বীকৃতি আছে, যেমন তিনজন পুরুষ তিন রুমে অন্য এক রুমে নারী থাকছেন। আবার উলটোটাও হয়। ঢাকায় এ ব্যাপারটা ঠিক চলে না। বিশেষ করে কোনো ছোট পরিবার যদি চায়ও তারা বাড়তি একটি রুমে একটি কর্মজীবী মেয়েকে শেয়ার করবেন না। বাড়ির কর্তার পক্ষ থেকে বাধা নেই। বাধা হচ্ছে গৃহিণী চাইবেন না। অথচ প্রায় তারা পুরুষ সাবলেট রাখা মেনে নেন। পুরুষকর্তা তার স্ত্রীর সঙ্গে একটা সম্পর্কের ভয় যে করেন না তা নয়। অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব বাধ্য করে। চেষ্টা করে ঘরের নারীকে যতটা সম্ভব পর্দায় রেখে বাড়তি প্রাপ্তি যোগ হোক। প্রায়ই ঠিকঠাক চলে, কখনও কোথাও অঘটন ঘটে। আপনাদের উদাহরণস্বরূপ কোনো গল্প বলতে পারলে ভালো হতো। থাকার ব্যাপারে সাবলেট আমার ভীষণ অপছন্দ বলে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। জীবনের শুরুতে চট্টগ্রাম থেকে বাবা বিতাড়িত অবস্থায় ঢাকা এসে সাবলেটে থাকার অনেক অভিজ্ঞতা থাকার কথা ছিল আমার অপছন্দের কারণেই নেই। তখনকার কামাইয়ের সিংহভাগ দিয়েছি ঘর ভাড়ায়, তবু একা থেকেছি। এর কারণও ছিল অবশ্য লেখা ও আঁকার জন্য একাকিত্ব ভীষণ দরকার। তবে ইচ্ছা না থাকা সত্তে¡ও মানুষ চক্করে পড়ে যায়, আমিও একবার পড়েছিলাম।

তখন জীবন আরম্ভকাল বিটপীতে তুচ্ছ আর্টিস্টের কাজ পেয়ে মগবাজার নয়াটোলায় এক রুমের এক বাসা নিয়েছি। ঘরের কোণে কেরসিন স্টোভে এক কুঁজোবুড়ি দিনে একবার এসে রান্না করে দেন। মাঝে মধ্যে টাকা নেন, তিনি সুবিধামতো রান্না করে প্লেটে তুলে ঢেকে রেখে যান। মুখে তার রেড ইন্ডিয়ান বুড়ির মতো শত ভাঁজ, শত রিংকেল। প্রায় সকালে খাওয়া যেমন ছিল তেমনি ঢাকা দেখে মহা বিরক্ত হতেন। মগবাজার মোড়ে ‘হোটেল ডি তাজ’ এর মুরগি বিরিয়ানির চুম্বক প্রায় বেশির ভাগ রাতই আমাকে টেনে নিত। অযথা বাজারে টাকা নষ্ট হচ্ছে! আমার কামাইও যে ভীষণ রকম ভালো ছিল তা নয়! তবে অভাব হতো না। টাকার টান শুরু হওয়ার আগেই মুক্তধারার চিত্তদা দুচারটি বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করার ডাক দিতেন। তাতে করে অবস্থা আবার লেভেলে চলে আসত। নয়াটোলা তখন গরিব মানুষের মেস-বাসা আর সাবলেটে টইটম্বুর এলাকা। বুড়ি বুয়া প্রায় বলতেন, আপনাকে লোক খুঁজে গেছে।
কেন?

রুমে চৌকি ফেলতে চায় আর কি!
কী?

আরে সাবলেট দেবেন কি না-রুমে জানতি চায়।
তখনও ছুটি রবিবার ছিল। ছুটির দিন দরজা বন্ধ করে লিখছি। প্রায় ডুবে আছি লেখার চরিত্র নিয়ে অন্য ভুবনে। ঠিক তখনই বারবার দরজায় টোকা। একবার, দুইবার নয়, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কয়েকবার। চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দরজা খুলে সেই একই আবদার- ‘আপনের রুমে জায়গা আছে, মাত্র দুইডা চৌকি পাতি।’

ইচ্ছা হতো ফুটবলের মতো পেটে লাথি মারি। তবে আমি সেই স্বভাবের নই। বিনীতভাবে মাফ চেয়ে বলতাম- না ভাই, সে রকম আমার ইচ্ছা নেই।
মাঝে মধ্যে আমাকে গালাগাল দিয়ে ফিরে যাচ্ছে শোনা যেত।

হালায় কী চাকরি করে, পাছায় এত্তো চর্বি। সাবলেট দেবে না! তেল কত্ত!

শেষ পর্যন্ত দরজায় হাতে চায়নিজ কালিতে কাগজে লিখে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলাম- ‘এখানে সাবলেট হবে না’। অবাক করা ভাবে সত্যিই দরজায় টোকা দেওয়া কমে গেল। ঠিক এ রকম সময় তিন দিন অফিসে না গিয়ে দরজা বন্ধ করে একটানা লিখে ফেলেছিলাম আমার জীবনের প্রথম বই ‘কুশল আর মৃত্যুবুড়ো’।

ঠিক এমনি সময় আমার রুম সাবলেট হয়ে ঢোকার উৎপাত বন্ধ হয়ে আচমকা ঠিক উলটো ঘটনা ঘটল। আমাকে সাবলেট হিসেবে নিয়ে যেতে সাজ্জাদ ভাই বদ্ধপরিকর। নিয়ে যাবেনই। এভাবে খাওয়ার ঠিক নেই- দাওয়ার ঠিক নেই। লন্ড্রিতে কাপড় ধুয়ে বেঁচে থাকা একটা জীবন হলো তার বাসায় একটা বাড়তি রুম আছে, এটাচ বাথরুমসহ। আসা-যাওয়ার দরজাও আলাদা। আমার ইচ্ছামতো তালা দিয়ে বেরিয়ে যাব ফিরে আসব। খাওয়াটা তারা টেবিলে ঢেকে রেখে যাবেন।
তবু যেতে ইচ্ছা করছিলো না। আমার বুড়ি বুয়াও চোখে জল তুললো। প্রায় জোর করেই তিনি ঠেলা আনিয়ে আমার একলা পালঙ্ক, একলা টেবিল- চেয়ার তুলে নিয়ে এলেন মৌচাক মার্কেটের পাশে তাদের বাসায়। তিনিও ভাড়া নিয়েছেন অন্যদের থেকে। বাথরুমসহ বেশ বড় রুম, দরজাও আলাদা। আমি তালা দিয়ে বেরিয়ে যেতাম, আমি ফিরে এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকতাম। খাওয়া বেশ ভালো। সাজ্জাদ ভাইয়ের বউ মজার সব রান্না করেন। অনেক কিছু টেবিলে সাজিয়ে রাখেন। রাতবিরাতে ফিরে এমন চমৎকার খানা খেয়ে ভীষণ ভালো লাগতো।
মনে হতে লাগলো আহ্ সাবলেট এতই মজার।

সাজ্জাদ ভাই ভালোই চেনা লোক। মাঝারি জাতের ব্যবসা আছে, সঙ্গে ছোট্ট ছেলে, তিন মেয়ে এবং ছোট শ্যালিকাকে নিয়ে থাকেন। শ্যালিকাটি মাত্র এসএসসি দিয়েছে। দেখতে সুন্দরী নয় আবার অসুন্দরী নয়। প্রায় শেষ রাতে ছোটদের একটি বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করে সব শেষ করে ঘরে বসি। আমার চেয়ে বয়সে বেশ ছোট মেয়েটি, তবে চলাফেরা বড়দের মতো। সকালবেলা চোখের পাতা খুলতে চায় না। মাঝে মাঝে মেয়েটি জানালা দিয়ে বেলি ফুল, জবা ফুল ছুড়ে ফেলে যেতো। আমার ঘুম ভাঙলেও চোখ মেলে দেখতাম না। ভয় হতো, হাজার হোক সাবলেটদাতার শ্যালিকা।

পরে বুঝলাম, সাজ্জাদ ভাই চান শ্যালিকার সঙ্গে বিয়ে। বুঝে অবাক হলাম। আমার মধ্যে এমন কী পেয়েছেন তিনি। সামান্য একটা চাকরি করি, কোনোভাবে চলি। বাড়ি থেকে বিতাড়িত। আবার ভেতরে ভেতরে নিজের জন্য কয়েক বিন্দু সম্মানবোধও জাগলো। আমাকেও গণনায় ধরার জন্য। তবে এই এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফলের অপেক্ষারত বালিকার সঙ্গে বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া তখন বদ্ধপরিকর ছিলাম বিয়ে করবো না। আমার জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে বিয়ে যায় না।
জানালা দিয়ে সকালবেলা ফুল ছোড়া থেমে থেমে চলছিলো। একদিন কাগজের টুকরোতে লেখা এলো। ‘ভোর হলো- দোর খোলো সকাল সকাল ওঠোরে….।’

হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভোর তিনটা-চারটা পর্যন্ত লিখে কিংবা এঁকে আর কোন ভোরে উঠবো! আমি তো ঘুমাই ভোরে, নয়টার অফিস সাড়ে নয়টায় পৌঁছে বকা খাই।

মনে মনে ঠিক করলাম, আগামী মাসে বলবো সাজ্জাদ ভাইকে- মাফ করেন, সাবলেট বন্ধন থেকে মুক্ত করেন। পালাই আবার একা জীবনে।
এর মধ্যে এক ছুটির দিনে দুপুরবেলা উপন্যাসের প্রায় শেষ দিকে আছি। শেষ কীভাবে করবো নিজেই ঠিক করতে পারছি না। এর মাঝে দরজায় ঠোকার পরে টোকা। সাজ্জাদ ভাই-ভাবী দাঁড়িয়ে।

এই যে তুমি আছো! বেরিয়ে ড্রইংরুমে এসো তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার মেজো শ্যালিকার জামাই সৌদি প্রবাসী, আজ সকালে এসেছে।
উপন্যাসের শেষের গুষ্টি মেরে যেতে হবে, উপায় নেই না গিয়ে। এ কিরে বাবা, একেবারে ছয় ফুট লম্বা হলিউডের রেম্বো নায়কের মতো দেখতে। মেজো শ্যালিকার স্বামীর চোখে রেবোন চশমা, পোলো ব্র্যান্ডের শার্ট, আমেরিকান লি কোম্পানির জিন্স প্যান্ট। সঙ্গে শ্যালিকা তো নয় পারভিন ববি দাঁড়িয়ে। মেজো শ্যালিকা এমন অপরূপ নায়িকার মতো হয় কী করে! আমার দিকে তাকিয়ে দু’জনই পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো।
শুধু হাসলে নয় কথা বললেও গালে টোলের ঘূর্ণি ওঠে পারভিন ববির। সুন্দর বড় বড় চোখে, ঘন কাজল। এমন সুন্দরী নারী মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
হাই-হুই বলে ঘুরে নিজের রুমে ঢোকার আগেই রেম্বো জামাই মেশিনগান চালানো শুরু করলো।
ভাইয়া, কোত্থেকে ধরে এনেছেন এসব গাঁজাখোর লেখক- টেখক! টাকা লাগলে আমাকে কল করতেন, সাবলেট দিয়ে এসব আজেবাজে লোক ঘরে ঢোকালেন!

হৃদয়ে সাবলেট দেয়া মুস্কিল। ভাড়া নেয়ার জাগায় উল্টো দিতে হয়

রেম্বোর কথা শুনে দুই কান দিয়ে রেল ইঞ্জিনের মতো গরম ধোঁয়া বেরোতে শুরু করেছিলো। শালা বলে কী! কে তাকে সাহস দিলো এসব কথা বলার! নিজেই লজ্জা পেলাম। সাহস তো আমি নিজেই দিয়েছি। না থাকতাম এই সাবলেট! তবে শোনাতে পারতো রেম্বোর বাচ্চা এসব কথা!
মাসের শুরু মাত্র। এই মাসের শেষের আগে ছাড়তে হবে সাবলেট। এরপরও কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছিল রেম্বোর সঙ্গে বাইরে বেরোনোর সময় সিঁড়ি ঘরে। কথা হয়নি, কেমন এক ঘেন্নার চোখে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিতো রেম্বো। ভাগ্য ভালো মাত্র এক হপ্তায় রেম্বো ফিরে গেলো সৌদি আরব। পারভিন বাবি পরে যাবে। পারভিন বাবির সঙ্গে মুখোমুখি হলে কিন্তু তার চোখে একরকম হাসি হাসি ভাব।

একদিন চিরকুট লেখা এলো। তিনি দেখা করতে চান বাইরে এক ফাস্টফুড দোকানে ধানমন্ডিতে। ভাবলাম দূর! কে যায়।
শেষ পর্যন্ত এড়াতে পারলাম না এই আকর্ষণীয় নারীর ডাক। গিয়ে দেখি ছোট বোনসহ এসেছে। সরাসরি পারভিন বাবি জানালো, আমি সব শুনেছি। সাজ্জাদ দুলাভাই ছোট বোনের বিয়ের চিন্তায় সাবলেট দিয়েছেন। আপনাদের লেখক আর্টিস্টদের তো চরিত্র ভালো না। কী সিদ্ধান্ত নেবেন জানি না। তবে বিয়ের আগে আমার বোনকে ফুসলে কখনো বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর আমার স্বামীর দুর্ব্যবহারের জন্য সরি! ওর একটা অসুখের জন্য মেজাজটা সবসময় খারাপ থাকে। কিছু মনে করেন না।

বলতে যাচ্ছিলাম, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি নিজে এ মাসের শেষে আপনার দুলাভাইয়ের বাসা ছেড়ে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে কান ধরে দেয়ালে তিনবার মাথায় ঠুকে প্রমিজ করবো, জীবনে আর সাবলেট নয়।

বলার সুযোগ পেলাম না। কোল্ড ড্রিংস শেষ না করে ওরা উঠে বেরিয়ে গেলো। এরপর পারভিন ববির চোখের হাসি বাড়তে লাগলো। আমার রুমের উত্তরে খালি গ্যারাজ। তখন হেঁচিপেঁচি সবার গাড়ি ছিল না। গ্যারাজের দিকের বড় জানালার গ্রিলের ওপারে দাঁড়িয়ে ভরা দুপুরে পারভিন ববি ডাকলো। আমি রুমের ভেতরে।

কাল খুব ভোরে আমি বোনসহ আমার শ^শুরবাড়ি পাবনা যাচ্ছি। পরশু বাস ধরে আপনি চলে আসবেন। আমার কাজিনদের ওরা নাম শুনেছে কিন্তু দেখেনি। কাজিন হিসেবে দু’চারদিন আমাদের সঙ্গে থাকবেন। কিছুটা বোঝাপড়ারও তো দরকার আছে। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে।
অসম্ভব। ছুটি পাবো না, সাহসও হবে না।
আপনার অফিসে খবর নিয়ে জেনেছি প্রায় তিন চারদিনের জন্য পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, টেকনাফ, গারো পাহাড়ে উধাও হয়ে যান। চাকরি যায় যায় অবস্থায় ফিরে আসেন। অ্যাডভেঞ্চার ইউ লাইক ইট, তুমি ভীতু নও।

আমি থ-মেরে গেলাম। ভাবলাম পালাতে হবে তা না হলে ঘূর্ণিস্রোতে পড়ে যাবো। পাহাড়ে যাওয়া, সাগরে যাওয়ার আর পাবনা যাওয়া কি এক হলো!
নির্বোধ বালিকার সঙ্গে বিয়ে করিয়ে আজীবন পাগলা গরাদে পুরে দেয় যদি। বললেই যাবো নাকি। অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি করছিলাম। বিকেল পড়ে আসতে পারভিন ববি আবার এলো। মাছরাঙ্গা পাখির মতো দ্রুত ঘরে ঢুকে জড়িয়ে ধরে দু’গালে কপালে চুমু খেয়ে চলে যেতে যেতে বললো-এবার যাবে?
ঘুম হারাম, শ্বাস নিতেও কেমন যেন লাগছে। খুব ভোরে আলো ফোটার আগেই শব্দ পেলাম যাওয়া আয়োজন চলছে। বিদেশ থেকে আনা বড় সব ব্যাগ নিয়ে বড় এক সরকারি জিপে দুবোন উঠলো। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে এক ঝলক চোখাচোখি হলো পারভিন ববির সঙ্গে। চোখের ঝিলিকে আমন্ত্রণ জানালো চকিতে। তারপর গাড়ি স্টার্ট নিয়ে ওদের নিয়ে চলে গেলো।

পরদিন খুব ভোরে হাজার চেষ্টা করে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। চরম শীতে মাংকি ক্যাপ আর অলিভ রঙের মোটা ইউএস আর্মি জ্যাকেট পরে ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড। দ্বিধায় কাটলো দুই ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত বাস ধরে ফেরিতে পদ্মা পেরিয়ে বিকেলে নামলাম পাবনা। ঘুরপাক খেয়ে বাড়িটির ঠিকানা দেখে বের করলাম। সাহস করে ভেতরে ঢুকতে আরও দুঘণ্টা পার। শেষ পর্যন্ত যেতেই হলো। ভীষণ খুশি দুবোন। দুপুর থেকে অপেক্ষায় আছি এতো দেরি কেন? ভয়ে?

বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়া কাজের লোক আর দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়রা থাকে। কাজিন হিসেবে বিশাল ভোজ শেষে ঘুমের আয়োজন। ফিসফিস করে কানের কাছে পারভিন ববি বললো-দরজা খোলা রেখো।

হাজার ক্লান্তিতেও ঘুম আসে না। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে টিকটিকির আলিঙ্গন দেখে মধ্যরাত। শেষে দিকে পারভিন ববি আলতোভাবে দরজা খুলে ঢুকলো। কেমন যেন থমথমে দুখী বেচারা। উঠে বিছানায় বসলাম। পাশে বসে আমার হাত ধরলো সে।

আমি জানি আমার বোনকে বিয়ে করবে না, বয়স আর মানসিকভাবেও ছোট অনেক। আমি তোমার কাছে একটা জিনিস চাই। আমার হ্যান্ডসাম সুপুরুষ বদমেজাজি স্বামীকে নিয়ে সৌদি আরব ও ইউরোপের অনেক বড় মেডিক্যালে গিয়েছি। সবার এক কথা ওর স্পার্মের সেল ডেড। সন্তান হবে না।
আগামী রাত থেকে যে করাত থাকো এখানে আমি লুকিয়ে চলে আসবো, তোমার সঙ্গে থাকবো। স্বামীকে বোঝাতে পারবো এ্যাডাপ্ট করার চেয়ে অন্তত আমার সন্তান হোক। তোমার চোখটা কেমন অদ্ভুত। চোখে চোখ রাখলে অন্তরে দৃষ্টি নেমে মাকড়সার মতো কাঁপে। আমি তোমাকে নির্বাচন করেছি। সারা জীবন আর কেউ জানবে না এই রহস্য।
এরপর পারভিন ববি মাথা নত করে চলে গেলো।

সেইরাত ভোরের ছিটা লাগতেই চুপিসারে জ্যাকেট পরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এই সব সম্পর্কের শিকড় পরবর্তীকালে জীবন খুব জটিল করে তোলে। পালাও বাছাধন। পালাও! মনের ভেতর পাগলা ঘণ্টা বাজতে শুরু করে দিল। দরজা খুলে বারান্দা পেরিয়ে বাাগান তারপর বাউন্ডারি গেইট খুললেই বড় রাস্তা। কিছুটা হাঁটা, তারপর রিকশায় সোজা বাসস্ট্যান্ড। ফেরিতে যখন বাস উঠেছে ভালোভাবে আলো ফুটছে চারদিক। কনকনে ঠান্ডা হুহু বাতাস। মধ্য নদীতে আমি ফেরির একবারে ছাদে উঠে চিৎকার করে বললাম- রেম্বো তোমাকে মাফ করলাম। যে কোনো পুরুষের এরকম অসুখ হলে মেজাজ খারাপ হতেই পারে। ঝামেলা মুক্ত পলায়নের জন্য নিজেকেও বাহবা দিলাম। ফিরে গিয়ে আজকালের মধ্যে সাজ্জাদ ভাইকে কিছু না বলে বাসা পালটাতে হবে। হৃদয়ে হতে পারে, বাসায় সাবলেট, জীবনে আর নয়।

স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles