5.5 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

মানুষ ও সমাজ

মানুষ ও সমাজ - the Bengali Times
ফাইল ছবি

আমার ছোটবেলার বন্ধু বড় বেলার বন্ধু সব বেলার বন্ধু জয়িতা। জয়িতা অত্যন্ত সুন্দরী এবং আধুনিক মেয়ে হিসাবে পরিচিত ছিল বন্ধু মহলে। জয়িতা বেড়াতে এসেছে আমার কাছে। আমার এই বন্ধুটির সাথে সব রকম গল্পের সাথে সাথে চলে হাসি দুষ্টামি। প্রাণ খুলে কথা বলার মতো মানুষ আমার এই বন্ধুটি। এভাবে গল্প আড্ডা দেবার সুযোগ আমাদের হয়ে উঠেনি বহু বছর। আমরা নিজেদের সংসারে ঢুকে যাবার পরে এবং দুজন দুদেশে থাকার ফলে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। এতদিন পরে একসাথে হওয়াতে আমরা দুই বন্ধু যেন হাতে চাঁদ পেলাম। এক মিনিটও আমরা নষ্ট করতে চাই না। এই কটা দিন যতভাবে আমরা পারি আনন্দ করবো। জয়িতার বর আসেনি তখনো, তিনি আসবেন কিছুদিন পরে। আহা কী আনন্দ! আমরা ফিরে গেলাম আমাদের ছাত্রজীবনে। নানারকম গল্প করতে করতে একদিন জয়িতা আমাকে বললো, ‘শোন দোস্ত, স্বামী কি আমাদের বাবা? শাসন করবে, দেখে শুনে রাখবে, কখন কী করলাম কোথায় গেলাম, কার সাথে ফোনে কথা বললাম ইত্যাদি খবর নিতে থাকবে। ইচ্ছা হলে আদর সোহাগ করবে, আবার সামান্য ব্যাপারে মেজাজ খারাপ হলে যা তা ব্যবহার করবে? যতক্ষণ তাদের মতে মত মিলিয়ে চলা যায় ততক্ষণ স্বামীরা খুশি। তাদের সাথে মতের অমিল হলেই তাদের আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে। শোন, আমার ইচ্ছা করে বৃষ্টির দিনে গান শুনতে শুনতে আমার স্বামীকে নিয়ে গাড়িতে করে একটু ঘুরে আসতে আর তখন আমার স্বামীর ইচ্ছা করে, নাক ডেকে ঘুমাতে। আবার যখন জোৎস্না রাতে ওর হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছা করে তখন ওর ইচ্ছা করে ঘরে বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে। শালা স্বামী, গুল্লিমারি এ ব্যাটাদের। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে গাছের সাথে বেঁধে যদি পিটাতে পারতাম স্বামীগুলোকে তাহলে মনের ঝালটা মিটতো।’

সেদিন জয়িতার কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েছিলাম। পরে মাথায় চিন্তা এলো জয়িতা তো কথাটা একেবারে হাসি-ঠাট্টা-ছলে বলেনি। স্বামীর সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক হওয়া উচিৎ ভালোবাসার সম্পর্ক, ভালো-মন্দ শেয়ার করার সম্পর্ক, একে অপরকে বোঝার সম্পর্ক। কিন্তু কয়টা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনের মিল আছে, বাহ্যিক মিল ছাড়া? অনেকটাই লোক দেখানো। আমাদের বাবারা আমাদের শাসন করেছেন আমাদের ভালোবাসতেন বলে আর স্বামীরা শাসন করে ভালোবাসে না বলে। কজন স্বামী একজন স্ত্রীর বন্ধু হতে পারে? কজন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আছে, মনের মিল? স্বামী যখন প্রেমিক থাকে তখন তার ভালোবাসার রূপ থাকে ভিন্ন। প্রেমিকার সাথে বৃষ্টিতে ভেজা, চাঁদের আলো দেখে মুগ্ধ হওয়া, কথায় কথায় গানের কলি, কবিতার লাইন মনে করা, তোমাকে না পেলে বাঁচবো না। এসব জিনিশগুলো বিয়ের পরে ¤øান হতে হতে শূন্যতে এসে দাঁড়ায়। তখন স্বামী তার স্বৈরাচারী রূপ খুব সহজেই ধারণ করে ফেলে।

- Advertisement -

পৃথিবী এখন আলোর গতিতে ছুটছে। সবকিছুই এখন অনেক বেশি মুক্ত, মুক্ত দুনিয়া, মুক্ত অর্থনীতি, মুক্ত মেলামেশা, মুক্ত আমোদ প্রমোদ। এই মুক্ত দুনিয়াতে শুধু মুক্তি নেই নারীদের। আমার অত্যন্ত পরিচিত একটি মেয়ে যে কি-না সংগ্রাম করে যাচ্ছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। নিজের চেষ্টাতে নিজস্ব ব্যবসাকে দাঁড় করাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে দিন-রাত। সে মেয়েটি একদিন দুঃখ করে বলেছিল, আপা স্বামী ছাড়া একা থাকি বলে সমাজের লোকজন সম্মান দিতে চায় না। কথাটা শুনে সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মেয়েটির স্বামী চরিত্রহীন এবং মেয়েটির উপর শারীরিক নির্যাতন করতো বলে মেয়েটি স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। তাছাড়াও স্বামীটি এতটাই দুশ্চরিত্র ছিল যে মেয়েটিকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাইরের মেয়েদের বিছানাতে এনে তুলতো। মেয়েটি প্রতিবাদ করলে তাকে মারধোর করতো। মেয়েটি অনেক চেষ্টা করেছিল স্বামীকে সংশোধন করতে কিন্তু হিতে হয়েছে বিপরীত। এই মেয়েটি স্বামীর ঘর ছেড়েছে বলে সমাজের মানুষদের কী সমস্যা হলো বুঝতে পারলাম না। স্বামী নামক সার্টিফিকেট কি এতই প্রয়োজন একটি মেয়ের জীবনে যে হাজারো যন্ত্রণা সহ্য করে তাকে থাকতে হবে স্বামীর ঘরে? একজন দুশ্চরিত্র স্ত্রীকে নিয়ে কী কোনো স্বামী সংসার করবে না করা উচিৎ? তাহলে একজন নারীকে কেন সংসার করতে হবে একজন দুশ্চরিত্র স্বামীর সাথে? অনেক নারীকে আবার করতে হয় যন্ত্রণার সংসার, কারণ তাদের পায়ের নিচে মাটি শক্ত না। তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াবার কোনো শক্তি নেই। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা একটি বিশাল জিনিশ। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল বলে অনেক স্ত্রীকে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করে থেকে যেতে হয়। তার সাথে কখনো জড়িয়ে থাকে পারিবারিক ও সামাজিক ভয়।

আবার আজকাল খুব দেখা যাচ্ছে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর একসাথে সংসার করার পরেও স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে অসহ্য লাগতে থাকে। এতটা বছর কী করে একসাথে কাটালো সেটা ভেবে দুজনই বিস্মিত হতে থাকে। দুজনই দুজনের কাছ থেকে মুক্তি পেলে যেন বেঁচে যায়। একসময় স্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন ছেলেমেয়ে দেখাশোনা-তাদের ঠিক মতো বড় করা, সংসারের নানা কাজকর্ম নিয়ে। স্বামী কাজে গেছেন ফিরে এসেছেন। এভাবেই একটা ধারাবাহিক জীবন চলে এসেছে। তারপরে যখন ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে যার যার মতো গুছিয়ে নিয়েছে, স্বামী কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন বা অবসর নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি অনেকটা সময় বাড়িতে থাকছেন। তখন একের কাছে অপরের দোষ-ক্রোটি চোখে পড়তে থাকে। স্ত্রীর নজরে পড়ে স্বামীর অহেতুক যন্ত্রণা, অকারণে খিটিমিটি করার স্বভাব। তখন স্ত্রী ভাবতে থাকেন এতটা বছর এই লোকটার সাথে জীবন কাটিয়ে জীবনটাই নষ্ট করলেন। বয়সের সাথে সাথে ধৈর্যশক্তি কমতে থাকে। কম বয়সে স্বামীর কঠিন কথাগুলো হয়তো গায়ে মাখেনি, এক সময় সেগুলো তার কাছে অসহ্য লাগতে থাকে। তখন ভাবতে থাকেন এভাবে অশান্তিময় জীবন কাটানোর চাইতে দুজন আলাদা থাকাটা অনেক মঙ্গলময়। অন্তত বাকিটা জীবন শান্তিতে কাটানো যাবে। তারপরও সবকিছু নির্ভর করে স্ত্রীটির নিজেকে চালাবার মতো আর্থিক সচ্ছলতার উপর। তা না-হলে আলাদা হয়েও স্বামীর কিংবা সন্তানদের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। কারো উপর নির্ভরশীল হওয়ার মতো বেদনাদায়ক আর কিছু নেই। আজকাল বিয়ের বহু বছর পরেও বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা প্রচুর দেখা যায়। বাইরের লোকেরা কখনো জানতে পারে না বন্ধ ঘরের ভিতরে কী ঘটেছিল বা ঘটছে। বিবাহ বিচ্ছেদ দিয়ে এসব ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে।

ঘর শব্দটি খুব শান্তির একটি শব্দ। সে শান্তির ঘরটি সাজিয়ে তোলে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে। ঘরকে শান্তিতে সুন্দর রাখতে হলে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলার ব্যাপার থাকে। থাকতে হয় একের প্রতি অপরের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস। সে বিশ্বাসের জায়গাতে যখন আঁচড় পড়ে তখন সংসার হয়ে উঠে দুর্বিষহ।

যুগ অনেক পাল্টে গেছে। এখন থেকে বিশ পঁচিশ বছর আগেও মানুষের যে মানসিকতা ছিল এখন আর সেটা নেই। আমাদের সাথে আমাদের মায়েদের মতের পার্থক্য ছিল খুবই সামান্য, মাঝে মাঝে একই রকম। কিন্তু এখনকার ছেলে-মেয়েদের সাথে আমাদের বাবা-মায়েদের চিন্তাভাবনা, মতামত আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যে ভাবনাগুলো ভাবে আমরা সে ভাবনাগুলো কখনো কল্পনা করতেও পারিনি। আর আমাদের ভাবনাগুলো তাদের কাছে মনে হয় সেকেলে, উদ্ভট। আসলে একাল সেকালের পার্থক্য আগেও ছিল, এখনো আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। এটাই পৃথিবীর ও সমাজের নিয়ম।

তবে এটা সত্যি আমাদের মা বাবাদের সময় এবং আমাদের অধিকাংশ দম্পতিকে দেখা যায় দুজনের মানসিকতা উত্তরমেরু দক্ষিণমেরুর থাকলেও সারাটা জীবন নির্বিগ্নে কাটিয়ে দিয়েছিল এবং দিচ্ছে। আমরা যে যুগের মানুষ তখন যে যেই মেরু থেকে আসি না কেন বিয়ের পরে মাঝামাঝি এক মেরুতে আসার চেষ্টা করে মহা আনন্দে আবার কেউ কেউ মহাদুঃখে জীবন কাটিয়ে দেয়।

তবে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা আমাদের মতো পুরানো চিন্তাধারাতে বিশ্বাসী না। তাদের মাঝে ব্যক্তিত্বের সমতা অনেক বড় ব্যাপার। সেটা না হলে সংসার করা সম্ভব না। ওরা সব চাইতে ভালোবাসে নিজেকে। ওরা বিশ্বাস করে জীবন তো একটাই। কেন জীবন কাটিয়ে দেবে এমন একজন মানুষের সাথে যার সাথে তার কোনো কিছুতেই মিলবে না। নিজেকে ভালোবাসা অত্যন্ত জরুরি। নিজেকে ভালোবাসলেই জীবনকে সুন্দর করা যায়। তাদের কাছে নারী পুরুষ কোনো ব্যাপার না। সবাই মানুষ, সবাইর সমান অধিকার। তাদের এই চিন্তাধারাকে প্রশংসা করতেই হবে। তবুও একেক সময় মনে হয়, কিছু কিছু ছেলে-মেয়ে বড্ড বেশি স্বার্থপর। আমাদের সময় আমরা নিজেদের চাইতে বেশি ভেবেছি সমাজের কথা, পরিবারের কথা, পাড়াপ্রতিবেশীদের কথা। এমন অনেক মেয়েকে চিনি, জীবনে কখনো সুখী হতে পারেনি নিজের সংসারে, তারপরেও দীর্ঘ অসুখী জীবন কাটিয়ে দিয়েছে সমাজের ভয়ে, পরিবারের সম্মানের দিকে তাকিয়ে, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। আমাদের এবং তার আগের সময়গুলো ছিল এক ধরনের চরম পর্যায়ের। আর এখনকার ছেলে-মেয়েদের চিন্তাধারা আরেক চরম পর্যায়ের। এ যুগের ছেলে-মেয়েদের মাঝে জটিলতা কুটিলতা যেমন কম, তার চাইতেও কম তাদের ধৈর্য শক্তি। সবকিছু একটু মাঝামাঝি পর্যায় হলে জীবন ও সমাজটা মনে হয় আরো অনেক সুন্দর হতো।

ম্যাল্টন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles