11.4 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

বেলাতন

বেলাতন - the Bengali Times
ছবি আর্টক পেসটোরিয়ন

শৈশব বেলা থেকে আজ পর্যন্ত কত মানুষের সাথে পরিচয় হলো, সখ্যতা হলো। দিনের পর দিন যাদের সাথে আনন্দ করেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি, পার্টি করেছি তাদের মাঝে অনেকের সাথে যোগাযোগ বন্ধুত্ব থাকলেও আবার কতজনই হারিয়ে গেলো। কোথায় হারালো সে খোঁজও জানি না। কী যেন এক ব্যস্ততায় সবাই জড়িয়ে আছি। শুধু ছুট আর ছুট। এ ছোটার যেন কোনো শেষ নেই।

শৈশবে যার সাথে হাড়ি পাতিল, পুতুল নিয়ে খেলে সময় কাটিয়েছি, আনন্দ করেছি, সে ছিল আমাদের বাড়ির কাজের বুয়ার মেয়ে ‘বেলাতন’। এই ছোট বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে কাজ করতে আসতো বেলাতনের মা। বেলাতনের সাথে খেলাটা ছিল আমার বিশাল আনন্দের ব্যাপার। বেলাতনের পুরো নামটা বলতে পারতাম না বলে আমি, ওকে ডাকতাম ‘বেলা’ বলে। আমার শৈশবের প্রথম সখী। বেলা আমার রান্নার জিনিশপত্র গুছাতো, তারপর আমরা মনের আনন্দে রান্না-বান্না খেলতাম।

- Advertisement -

একটু বড় হয়ে বেলার সাথে অমার খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেলো। আমি স্কুলে যাই, বেলাতন যেতে পারে না। বেলাতন কেন আমার সাথে স্কুলে যেতে পারবে না, কেন স্কুলে গিয়ে আমার সাথে খেলতে পারবে না? আমার এসব আব্দার অবাস্তব হয়ে রইলো। ধীরে ধীরে আমার প্রিয় সখী বেলার সাথে আমার খেলা বন্ধ হয়ে গেল। আমি স্কুল থেকে ফিরলে আমাকে খাওয়া দাওয়া করানো ঘুম পাড়ানো এসব নিয়ে মা ব্যস্ত। বেলাতন করুণ চোখে আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকতো। আমি হাতের ঈশারায় বেলাতনকে কাছে ডাকতাম। দেখাতাম আমার প্রথম স্কুলে যাবার রঙিন ছবি আঁকা বইগুলো। বেলাতনকে বলতাম, ‘বলো বেলা অ তে অজগর আ তে আম, এ ফর আপেল বি ফর বল’। বেলার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠতো। এখন বুঝতে পারি বেলার কী অদম্য ইচ্ছে ছিল স্কুলে যাবার আমার মতো করে পড়ার ‘অ তে অজগর আ তে আম ’। ধীরে-ধীরে বেলাতনের অস্তিত্ব আমার জীবন থেকে বিলীন হয়ে গেলো।

একবার বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে গিয়ে বেলাতনের সাথে দেখা। বেলাতন এখন তার মায়ের কাজগুলো আমাদের বাড়িতে করে। তার একটি ছেলে। বেলাতনের মায়ের মতো বেলাতনও তার ছেলেকে নিয়ে কাজে আসে। আমাকে দেখে বেলাতনের মুখে হাসি আর ধরে না। আমি তো বিশ্বাসই করতে পাছিলাম না এ আমার শৈশবের প্রিয় বন্ধু বেলাতন। মোটাসোটা মুখ ভরতি পান চপচপ করে খাচ্ছে। আমি বেলাতনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, শৈশবে আমার আর বেলাতনের মাঝে কোনো পার্থক্য ছিল না। বেলাতন ছিল আমার প্রতিদিনের প্রিয় বন্ধু। এখন আমাদের অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন। এখন বেলাতন আমার পাশে বসবার সাহস পায় না। আমি অতি আগ্রহ নিয়ে বেলাতনের কাছে তার জীবনের গল্প শুনতে চাইলাম। মেঝেতে বসে গালে হাত দিয়ে বিনা দ্বিধাতে বেলাতন তার জীবনের কত গল্প শোনালো। জানতে চাইলো আমার জীবনটা কতো আনন্দের? বেলাতনের বিয়ে হয়েছিল একজন রিকশা চালকের সাথে। স্বামীর মারধোর ভালোবাসা সব মিলিয়ে জীবন মন্দ কাটছিল না। একদিন বেলাতন খবর পেলো গ্রামে তার আরেকটি স্ত্রী আছে, দুটো সন্তান আছে। শহরে রিকশা চালিয়ে থাকা খাওয়ার সুবিধার জন্য বেলাতনকে বিয়ে করা। বেলাতন সহ্য করতে পারলো না তার জীবনে সতীনের অস্তিত্ব এবং স্বামী দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ব্যাপারটি, তাই সে স্বামীকে তার জীবন থেকে তাড়িয়ে দেয়। আবার বেলাতনের জীবন কাটতে থাকে তার মায়ের সাথে এ বাড়ি সে বাড়ি কাজ করে। মায়ের মনে শান্তি নেই। যুবতী মেয়ে এবাড়ি অবাড়ি ঘুরে কাজ করে কখন কী হয় বলা তো যায় না। বেলাতনের আবার বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। পাত্র প্যান্ট সার্ট পরা, চোখে কালো চশমা, হাতে ঘড়ি। বেলাতনের মনে খুশির দোলা লাগলো। তার দ্বিতীয় স্বামী সিনেমার নায়কের মতো হবে সে কি কখনো ভেবেছিল? বেলাতন ফুটপাথের সোনার গয়না, ধার করা লাল রঙের মালা শাড়ি পরে সাজলো। বিয়ে হলো বেলাতনের এক রাতের জন্য। বিয়ের রাত ভোর হবার আগেই তার স্বামী বেলাতনকে ঘুমন্ত অবস্থাতে রেখে পালিয়ে গেলো। সাথে নিয়ে গেলো বেলাতনের কষ্টে অর্জিত টাকা দিয়ে সখ করে কেনা রেডিওটা। সেদিন বেলাতন ক্রোধের চাইতেও অপমান বোধ করেছিল বেশি। এরপর থেকে বেলাতন বিয়ের কথা কখনো ভাবেনি।

এভাবে চলতে চলতে বেলাতনের মাথায় ভাবনা আসলো, বৃদ্ধ বয়েসে কে তাকে দেখাশোনা করবে? কে ভাত কাপড় দেবে? তার একটি সন্তানের বড় প্রয়োজন কিন্তু স্বামীর কোনো প্রয়োজন নেই। বেলাতন গর্ভবতী হলো কিন্তু সন্তানের পিতার নাম চিরদিন গোপন থাকবে সে চুক্তিতে সম্মতি জানিয়ে। বেলাতন মা হলো পুত্র সন্তানের। ভবিষ্যতে ভাত কাপড়ের চিন্তা দূর হল তার। আমি অবাক হয়ে কপাল কুঞ্চিত করে বেলাতনকে বললাম, ‘ছিঃ বেলাতন তুই ভয় পেলি না সমাজের এমন একটা কাজ করতে?’ বেলাতন হেসে জবাব দিল, ‘সমাজ কারে কয় গো আপা? আমাগো কোনো সমাজ নাই, সমাজ কি আমারে ভাত কাপড় দিবো?’ আমি বোকার মতো চেহারা করে বললাম, ‘তা তো ঠিকই’। ভাবলাম উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্তদের সমাজ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এই দুই শ্রেণিই বেপরোয়া। এক শ্রেণি অর্থের দাপটে আর এক শ্রেণি অর্থের অভাবে।

বেলাতনের সাথে কথা বলতে বলতে তার জীবনের কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে এলো। ছোটবেলায় আমরা দুজন যখন হাত ধরাধরি করে ছুটে বেড়াতাম তখন আমাদের শিশু মনে কি কখনো জেগেছিল আমাদের অবস্থানের ব্যবধান অনেক। ছোটবেলায় যে মেয়েটির হাত ধরে প্রজাপতি খুঁজেছি আমি কি এখন পারবো সে মেয়েটিকে হাত ধরে আমার পাশে সোফায় বসিয়ে গল্প করতে। শিশুবেলাতে যে মেয়েটির সাথে মিছিমিছি একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করেছি আজ আমি কি বলতে পারবো, বেলা আসো আমার পাশে টেবিলে বসে খাও। বড় হতে হতে সরল শৈশব কোথায় হারিয়ে যায়। আমরা যত বড় হতে থাকি মনটা তত ছোট হতে থাকে। সরলতা হারিয়ে যায় জীবন থেকে। জটিলতার বাঁধনে আটকে পড়ি আমরা। বেলাতনরা অসম বন্ধুত্বের কাছে হার মেনে যায়। সামাজিক রীতি-নীতিতে আমরা সবাই আবদ্ধ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার শক্তি কজন মানুষের আছে। আমার ভেবে বড় কষ্ট হয় আমি যদি পারতাম আবার বেলাতনের শৈশবের বন্ধু হতে। আবার যদি পারতাম আমার সহজ সরল শৈশবকে একবার ছুঁয়ে দেখতে।

ম্যাল্টন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles